রাশিয়ার ভর্কুটা শহর, যা ভূতের শহর বা “ঘোস্ট টাউন” নামে পরিচিত, একসময় ছিল একটি সমৃদ্ধ শহর। এই শহরটি শুধুমাত্র রাশিয়া নয়, পুরো ইউরোপের অন্যতম শীতলতম স্থান হিসেবে পরিচিত। ভর্কুটার তাপমাত্রা সাধারণত -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যেতে পারে, যা স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রায় অসম্ভব করে তোলে। এই ভয়ানক ঠান্ডার ফলে শহরটি এখন প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে গেছে এবং এটি কার্যত একটি “ভূতের শহর” হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

ভর্কুটা শহরটি রাশিয়ার কমি প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত এবং এটি আর্কটিক সার্কেলের কাছাকাছি। শহরটি রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব দিকে, উরাল পর্বতমালার সন্নিকটে অবস্থিত। এর ইতিহাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাম্যবাদী যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত। সোভিয়েত যুগে এখানে কয়লা খনির জন্য শহরটি গড়ে ওঠে। ১৯৩০-এর দশকে সোভিয়েত সরকার কয়লা উত্তোলনের জন্য শহরটি প্রতিষ্ঠা করে এবং শহরের উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করা হয়।

কালীগঞ্জে হত্যা মামলায় ২ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

শুরুতে ভর্কুটার প্রধান আকর্ষণ ছিল এখানকার বিশাল কয়লা খনি। ১৯৩২ সালে কয়লা উত্তোলন শুরু হয় এবং এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প শহর হিসেবে পরিচিতি পায়। শহরটির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক এখানে চলে আসেন, এবং শহরটি দ্রুত একটি জনবহুল নগরীতে পরিণত হয়।

কিন্তু এখানকার চরম ঠান্ডা আবহাওয়া এবং প্রতিকূল পরিবেশের কারণে এখানকার জীবনযাত্রা ক্রমশ কঠিন হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে শহরটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। কয়লা খনির কার্যক্রম কমে আসায় এবং বিকল্প জীবিকার অভাবে শহরের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।

ভর্কুটার আবহাওয়া অত্যন্ত চরম। শীতকাল এখানে দীর্ঘ এবং অসহনীয়। শীতকালে তাপমাত্রা -৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নেমে যেতে পারে, যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত। এই চরম ঠান্ডার কারণে শহরের অনেক এলাকা স্থায়ীভাবে বরফে ঢেকে থাকে।

ভর্কুটার শীতের পরিবেশটি অনেকটাই ডিপ ফ্রিজের মতো, যেখানে সবকিছু জমে যায়। শহরের বাড়িঘরগুলোতে তাপমাত্রা এতটাই নিচে থাকে যে ঘরের ভেতরের আসবাবপত্র, জানালা, দরজা পর্যন্ত বরফে ঢেকে যায়। এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় পানি এবং গ্যাসের লাইনগুলোও বরফে জমে যেতে পারে। অনেক বাড়িঘর এই পরিবেশের কারণে পরিত্যক্ত হয়েছে। শহরের কিছু এলাকায় এখন কেবল বরফের স্তূপ দেখা যায়।

ব্যারিস্টার সৈয়দ মোহাম্মদ সালেহউদ্দিনের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা 

শহরটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ইতিমধ্যেই শহর ছেড়ে চলে গেছে, এবং যারা এখনও সেখানে বাস করছেন, তারা অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। ভর্কুটার চরম ঠান্ডা এবং এর ফলে তৈরি হওয়া প্রতিকূল পরিবেশের জন্য এটি ধীরে ধীরে একটি ভূতের শহরে পরিণত হচ্ছে।

ভর্কুটার পতনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এখানকার কয়লা খনি শিল্পের ধস। সোভিয়েত যুগে শহরটি মূলত কয়লা খনির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কয়লার চাহিদা কমে যায়, এবং এর ফলে শহরের অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খায়।

খনি শিল্পের পতনের সঙ্গে সঙ্গে শহরের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে ওঠে। খনি শ্রমিকেরা একে একে শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন, কারণ এখানে আর কোনো স্থায়ী চাকরি বা আয়ের উৎস ছিল না। এর ফলে শহরের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। শহরের স্কুল, হাসপাতাল এবং অন্যান্য পরিষেবাও বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে, ভর্কুটার প্রধান বাসিন্দারা শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যান, এবং শহরটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।

বর্তমানে ভর্কুটা শহরটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এখানে অনেক ঘরবাড়ি এবং ভবন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। কিছু জায়গায় বাড়িগুলো এতটাই পুরোনো হয়ে গেছে যে সেগুলো ধসে পড়ার মতো অবস্থায় রয়েছে। এ শহরের রাস্তাঘাটগুলোও প্রায় খালি, কেবলমাত্র বরফের স্তূপে ঢাকা পড়ে থাকে।

শহরের অবশিষ্ট বাসিন্দারা যারা এখনো এখানে রয়েছেন, তারা অসহনীয় শীত এবং প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করছেন। শহরে খাবার এবং জ্বালানির সরবরাহ অত্যন্ত সীমিত। অনেক বাসিন্দা গরম রাখার জন্য বিকল্প উপায় খোঁজেন, কিন্তু তা অনেক সময় যথেষ্ট হয় না। বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য মৌলিক পরিষেবাও এখানে অনিয়মিত।

একসময়কার জমজমাট এই শহরটি এখন প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিস্তব্ধ এবং পরিত্যক্ত। শহরের বেশিরভাগ অংশ এখন জনশূন্য, এবং এখানে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। ভর্কুটা এখন রাশিয়ার সবচেয়ে শীতলতম এবং সবচেয়ে পরিত্যক্ত শহরগুলির একটি হিসেবে পরিচিত।

ভর্কুটার ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এই শহরটির পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়, কারণ এখানকার পরিবেশ এবং আবহাওয়া মানুষের জীবনযাপনের জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল। তবে, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, সঠিক নীতিমালা এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে শহরটিকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হতে পারে।

অন্যদিকে, এই শহরটি একটি পর্যটন আকর্ষণ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। অনেক মানুষ ভূতের শহরগুলোতে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন, এবং ভর্কুটার অনন্য ইতিহাস এবং ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। শহরটির চরম শীত এবং ভৌগোলিক বৈচিত্র্য অনেক পর্যটকের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে।

ঝিনাইদহে এমপি আনার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবীতে মানববন্ধন

ভর্কুটা শহরটি রাশিয়ার একটি প্রতীকী শহর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যা সোভিয়েত যুগের উত্তরণ এবং পতনের একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। একসময়কার সমৃদ্ধ শিল্প নগরী, যা এখন চরম ঠান্ডার কবলে পড়ে একটি ভূতের শহরে পরিণত হয়েছে। এই শহরের বর্তমান অবস্থা রাশিয়ার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবনতির একটি বাস্তব উদাহরণ।

ভর্কুটার বর্তমান চিত্র এবং তার ইতিহাস আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়—কিভাবে প্রকৃতি এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন একটি সমৃদ্ধ শহরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ভর্কুটা এখন ইতিহাসের একটি অংশ, কিন্তু এর চরম শীতলতা এবং ভূতের শহরের পরিবেশ একে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে।

shoberkotha

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version