ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) একসময় যে প্রানবন্ত ও কোলাহলপূর্ণ দপ্তর হিসেবে কাজ করতো, এখন তা অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। জনবল সংকট, রাজনৈতিক প্রভাব, টেন্ডারবাজি, এবং নির্বাহী প্রকৌশলীদের মারধরের মতো ঘটনাগুলো এই সরকারি দপ্তরকে কার্যত অচল করে তুলেছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থমকে গেছে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গাছাড়া মনোভাব নিয়ে কাজ করছেন, অফিসের বেশিরভাগ সময়ই অলসভাবে কাটাচ্ছেন। ২০১৪ সালের পর থেকে ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডে কোনো নির্বাহী প্রকৌশলী স্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি, যা এই সংকটের অন্যতম কারণ।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে ওয়াইফাই রাউটারগুলি সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেবিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে ওয়াইফাই রাউটারগুলি সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে

ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বর্তমান স্থবিরতার শুরু মূলত ২০১৪ সালে। ওই সময় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর ভাতিজা শাহরিয়ার করিম রাসেল কর্তৃক নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল লতিফকে মারধরের ঘটনা ঘটে। এই হামলার পর, প্রকৌশলীর অফিস ভাঙচুর করা হয়। হামলা ও ভাঙচুরের খবর দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এতে পুরো দপ্তরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে ঝিনাইদহে কোনো নির্বাহী প্রকৌশলী কাজ করতে সাহস পাননি। যারা এখানে নিয়োগ পেয়েছিলেন, তারাও ভয়ে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ফলে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।

কালীগঞ্জে বিজেপির মোটরসাইকেল র‍্যালি ও লিফলেট বিতরণ

এছাড়া টেন্ডার নিয়ে দলীয় নেতাদের দৌরাত্ম্য এবং প্রকৌশলীদের হুমকি-ধামকি দেওয়ার বিষয়টিও পরিষ্কারভাবে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ব্যাহত করেছে। এই পরিস্থিতিতে উন্নয়নমূলক কাজ যেমন থেমে গেছে, তেমনি স্থানীয় জনগণও তাদের প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারি সম্পদ যেমন সেচখাল, নদী এবং বোর্ডের বিশাল ভূসম্পত্তি বেদখল হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত লোকবল বা কার্যকরী নেতৃত্ব নেই।

ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকান্ডের স্থবিরতার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে জনবল সংকট। জেলা অফিসের মোট ১৪টি পদের মধ্যে নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীসহ ১০টি পদ শূন্য রয়েছে। বিভিন্ন সাব-ডিভিশন ও সেকশন অফিসগুলোতেও মোট ৬৫টি পদের মধ্যে ৩৭টি পদ শুন্য। এই শূন্যপদগুলো পূরণ না হওয়ায় বোর্ডের কাজ সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় লোকবল ছাড়া বোর্ডের বিশাল ভুসম্পত্তি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর ফলে, জেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা সাব-ডিভিশন অফিসগুলো ভেঙে পড়েছে, দরজা-জানালা চুরি হয়ে গেছে, এবং মূল্যবান গাছ পর্যন্ত চুরি হয়ে গেছে।

১০ম গ্রেড বাস্তবায়নের দাবিতে ঝিনাইদহে সহকারী শিক্ষকদের মানববন্ধন

সার্ভেয়ার আব্দুল বাতেন জানান, ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় ৭ হাজার একর জমি রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় ৭০ থেকে ৮০ একর জমি ইতোমধ্যেই বেদখল হয়ে গেছে। নদী এবং সেচখালের জায়গায় ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, যা সরকারের সম্পদ বেহাত হওয়ার একটি বড় উদাহরণ। এর সাথে, হরিণাকুন্ডু, শৈলকুপা এবং সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সেচখাল এবং নদীর পাড় দখল করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। সরকারী সম্পদ রক্ষা করতে এবং দখলমুক্ত অভিযান পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জনবল নেই, ফলে অব্যবস্থাপনা আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

বিগত ১৬ বছর ধরে ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন কর্মকান্ড হয়নি। যতটুকু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে, তা দলীয় নেতাদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরটি বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। ফলে, জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে এবং নতুন প্রকল্পের অভাবে জনগণ সঠিক সেবা পাচ্ছে না।

ঝিনাইদহ পৌরসভায় সেবা ব্যবস্থার দুরবস্থা

এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাখা কর্মকর্তা মিনহাজুল ইসলাম জানান, জনবল সংকটের কারণে কোনো কাজই ঠিকমতো করা সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে বোর্ডের বিশাল ভূসম্পত্তি রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছেন, অন্যদিকে কাজ না থাকার কারণে সাব-ডিভিশন অফিসগুলো ভেঙে পড়ছে। উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ লোকবলের প্রয়োজন, তা না থাকায় কার্যত কোনো উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে পুনর্জ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি। নতুনভাবে পদায়নকৃত নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস জানান, সরকারের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তাকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বোর্ডকে পুনর্জ্জীবিত করতে এবং শূন্যপদে লোকবল নিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানটিকে পুনরায় সক্রিয় করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি বোর্ডের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধান এবং উন্নয়নমূলক কাজ পুনরায় শুরু করার আশ্বাস দেন।

তবে, বাস্তবায়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্থানীয় নেতাদের দৌরাত্ম্য। নির্বাহী প্রকৌশলীর কাজ শুরু করার জন্য একটি নিরাপদ এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এতে প্রশাসন এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হতে পারে, যাতে করে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি কর্মপরিসর তৈরি করা যায়।

ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে কার্যকরী করতে এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোকে পুনরায় গতিশীল করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে বোর্ডের বর্তমান সংকট নিরসন সম্ভব হতে পারে:

  1. জনবল নিয়োগ: বোর্ডে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে শূন্যপদ পূরণ করে বোর্ডের কর্মকান্ডকে পুনরায় সচল করতে হবে। নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, এবং অন্যান্য পদে দক্ষ এবং পেশাদার কর্মী নিয়োগ করা জরুরি।
  2. রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কর্মপরিসর তৈরি: বোর্ডের কর্মকান্ডে রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে হবে এবং নির্বাহী প্রকৌশলীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
  3. উন্নয়ন প্রকল্প চালু: ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প চালু করতে হবে। বিশেষ করে, সেচখাল এবং নদী পুনর্খনন, বাঁধ নির্মাণ, এবং সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা জরুরি। এতে করে কৃষিকাজে পানি সরবরাহ বাড়বে এবং এলাকার কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
  4. ভূসম্পত্তি রক্ষা: বোর্ডের অধীনে থাকা বিশাল ভূসম্পত্তি রক্ষা করতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। বেদখল হয়ে যাওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করতে এবং অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে যথাযথ আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে।
  5. অডিট এবং স্বচ্ছতা: বোর্ডের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত অডিট করা জরুরি। এতে করে বোর্ডের কার্যক্রমে দুর্নীতি কমবে এবং অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
  6. সর্বস্তরে সমন্বয়: জেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করতে হবে। এতে কাজের গতি বাড়বে এবং বোর্ডের স্থবিরতা কাটবে।

ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ড বর্তমানে এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। রাজনৈতিক প্রভাব, জনবল সংকট, এবং উন্নয়নমূলক কাজের অভাবে বোর্ডের কার্যক্রম প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তবে, নতুনভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাসের নেতৃত্বে এই সংকট কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। যথাযথ পরিকল্পনা এবং উদ্যোগের মাধ্যমে বোর্ডকে পুনর্জ্জীবিত করা সম্ভব, এবং এতে করে এলাকার কৃষি ও সেচ ব্যবস্থা উন্নত হবে।

হরিণাকুণ্ডুতে সাপের কামড়ে এক যুবকের মৃত্যু

সরকারি সম্পদ রক্ষা, উন্নয়ন প্রকল্প পুনরায় চালু করা, এবং জনবল নিয়োগের মাধ্যমে ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ড আবারো তার কার্যক্রমে প্রাণবন্ত হতে পারে। তবে এজন্য রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত একটি কর্মপরিসর নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

shoberkotha

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version