সাম্প্রতিককালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও, যেখানে ভ্যানে লাশের স্তূপ দেখা গেছে, সেটি সাভারের আশুলিয়া বাইপাইল এলাকার একটি ঘটনা বলে জানা গেছে। দৈনিক মানবজমিন এবং দৈনিক ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় এই ঘটনাটি নিয়ে বিশদভাবে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ভিডিওটি এবং ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধান এবং প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের খবর প্রচারের পর সাভারের বাইপাইল এলাকায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এই খবরে আন্দোলনকারীরা বিজয় মিছিল বের করেন এবং পরে থানা ঘেরাও করেন। এ সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং উত্তেজিত জনতা থানায় ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন, এমনকি কেউ কেউ গেট ভাঙার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি চালায়, যার ফলে ঘটনাস্থলেই কয়েকজন নিহত হন।

দাম কমল জ্বালানি তেলের, আজ রাত ১২টা থেকে কার্যকর

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ সাতজনের মরদেহ একটি ভ্যানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। পুলিশের এই পদক্ষেপের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জনমনে আতঙ্ক এবং ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ভিডিওটি ১৪ সেকেন্ডের হলেও তা মানুষের মধ্যে একটি গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, থানার পাশে ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টারের দেয়াল ঘেঁষে গুলিবিদ্ধ মরদেহগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। পরে পুলিশ ওই মরদেহগুলো ভ্যানে স্তূপ করে রাখে, এবং কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি অনুযায়ী, পরবর্তীতে মরদেহগুলোতে আগুন দেওয়া হয়।

ঘটনার প্রকৃত তথ্য জানার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, এই ভিডিওটি তিনি নিজেও দেখেছেন এবং ভিডিওটি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। যে কোনো তথ্য বা সূত্র পেলে মিডিয়া কর্মীদের পুলিশকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ইত্তেফাকের প্রতিবেদন এবং ঘটনার স্থান চিহ্নিতকরণ

দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে স্থানীয় যুবলীগের একটি পোস্টার দেখা গেছে, যা ধামসোনা ইউনিয়নের সভাপতি ও চৌরাওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেনের। এই পোস্টারটি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ঘটনাস্থল আশুলিয়া থানার পাশেই। স্থানীয় এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভিডিওতে দেখা দেয়াল এবং স্থানীয় রাস্তার দৃশ্য হুবহু মিলেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেদিন সকাল থেকেই নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকায় বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীরা জড়ো হতে থাকেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে তারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং থানা ঘেরাও করেন। পুলিশের গুলি চালানোর পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, বিকেল ৪টার দিকে এই ঘটনা ঘটেছে, তবে তিনি লাশ ভ্যানে স্তূপ করার দৃশ্য দেখেননি।

এই ভিডিওটি প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের এই ধরনের আচরণে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

সরকারি কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন যে, এই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভিডিওটি এবং অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈন তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত ফলাফলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

মনিরুল গণভবন থেকে প্রায় ২৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন, যা ছাত্র আন্দোলন দমাতে

সাভারের আশুলিয়ায় ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি দেশের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বিতর্কিত ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ভিডিওটির সত্যতা যাচাই এবং প্রকৃত ঘটনার অনুসন্ধানে সরকারের পদক্ষেপ এবং আইনি প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জনমনে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ অপরিহার্য। এই ধরনের ঘটনা এড়াতে ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সতর্ক এবং সংবেদনশীল হতে হবে।

 

প্রথম আলোক

মাথায় পুলিশের হেলমেট। সাদাপোশাকের ওপর পুলিশের ভেস্ট পরা এক ব্যক্তি আরেকজনের সহায়তায় চ্যাংদোলা করে নিথর এক যুবকের দুই হাত ধরে ভ্যানের ওপর তুলছেন। ভ্যানের ওপর আরও কয়েকটি নিথর দেহ স্তূপ করে রাখা। দেহগুলো থেকে ঝরে পড়া রক্তে ভিজে গেছে সড়কের কিছু অংশ। বিছানার চাদরের মতো একটি চাদর দিয়ে তাঁদের ঢেকে রাখা হয়েছে। পাশেই পুলিশের হেলমেট, ভেস্ট পরা আরও কয়েকজনকে দেখা যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওটি সাভারের আশুলিয়া থানা-সংলগ্ন এলাকার বলে দাবি করেছেন অনেকে। এএফপির ফ্যাক্ট-চেকিং এডিটর কদরুদ্দীন শিশির তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে ঘটনাটি ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার নিকটবর্তী এলাকায় বলে উল্লেখ করেছেন।

সরেজমিনে ভিডিওটির আশপাশের নানা বিষয় পর্যালোচনা করে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে স্থানটি আশুলিয়া থানা লাগোয়া ‘ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লি. অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টারের’ পাশের সড়ক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

মীর মাহফুজুর রহমান ‘মুগ্ধ’ শুধুমাত্র একটি নাম নয়, বরং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার উৎখাতে আন্দোলনের আত্মত্যাগের মূর্ত প্রতীক

ঘটনাস্থল হিসেবে দাবি করা জায়গাটি থেকে ১০ থেকে ১৫ ফুটের দূরত্বে ‘সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারি অ্যান্ড মিষ্টান্ন ভান্ডার’ নামে একটি দোকান আছে। দোকানের মালিক ফাহিমাকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি দেখানো হলে তিনি স্থানটি নিশ্চিত করেন। ফাহিমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘হ্যা, এটাই ওই জায়গা। বালুর বস্তা পালা দিয়ে ব্যারিকেড বানিয়ে ছিল।’

ভিডিওটিতে আরও দেখা যায়, ঘটনাস্থলের পাশের ‘ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লি. অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টার’-এর দেয়ালে নির্বাচনী পোস্টার টাঙানো আছে। দেয়ালের ভেতরের অংশের একটি গাছের পাতা এসে পড়েছে সড়কের দিকে। দেয়ালের একটি অংশে কিছুটা বাঁক আছে। দেয়ালের নিচের দিকে কিছু অংশ কালো।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, ভিডিওটি ঘটনাস্থলের পাশেই একটি তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে বাড়ির একাধিক ভাড়াটে ও মালিকের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা ভিডিওর ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দেয়ালে আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদপ্রার্থী আবুল হোসেনের ছবি-সংবলিত পোস্টারটিতে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। দেয়ালের ভেতরের অংশের গাছটি আমগাছ। সেটির পাতা সড়কের দিকে এসেছে। দেয়ালের একটি অংশে বাঁক দেখা যায়। দেয়ালের নিচের দিকে কিছু অংশে কালো রং করা হয়েছে।

ভিডিওতে হেলমেট হাত ও পুলিশের ভেস্ট পরা ব্যক্তি ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলে দাবি করছেন অনেকে। এ বিষয়ে কথা বলতে ওই কর্মকর্তার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বিচার গুলি চালালে বেশ কয়েকজন নিহত হন। আহত হন অনেকে। রাতে আশুলিয়া থানার অদূরে নবীনগর থেকে চন্দ্রাগামী মহাসড়কের এক পাশে পুলিশ লেখা পিকআপের আগুনে ভস্মীভূত অন্তত দুটি মরদেহ দেখেন তাঁরা। এ ছাড়া থানার সামনে আগুনে পোড়া একটি মরদেহ ছিল। পদচারী–সেতুতে উল্টো করে ঝোলানো ছিল ক্ষতবিক্ষত দুই পুলিশ সদস্যের লাশ। তখন স্থানীয় লোকজন আগুনে ভস্মীভূত একাধিক লাশ পিকআপে থাকতে পারে বলে ধারণা করেছিলেন। ওই রাতে আশুলিয়া থানায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

উদ্বোধনের দীর্ঘদিন পরেও ঝিনাইদহের ২৫ শয্যা বিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল সঠিকভাবে কার্যকর না হয়ে ধীরে ধীরে চলমান

পরদিন পুলিশ লেখা পিকআপে আগুনে পুড়ে যাওয়া একজনকে শনাক্ত করেছিলেন বলে স্বজনেরা জানান। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেনের মা শাহিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫ আগস্ট থেকে ছেলে নিখোঁজ ছিল। পরদিন পুলিশের পিকআপ থেকে আগুনে পোড়া লাশ পাই। লাশের পকেটে আইডি কার্ড দেখে ছেলের লাশ চিনতে পারি। ৭ তারিখে গাইবান্ধার শ্যামপুর গ্রামে লাশ দাফন করেছি।’

আশুলিয়া এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্যমতে, আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় হামলার ঘটনায় ১৪ জন নিহত হন। এ ছাড়া আশুলিয়া থানা এলাকায় তিনজন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত পাঁচজন নিহত হন।

দাম কমল জ্বালানি তেলের, আজ রাত ১২টা থেকে কার্যকর

ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিডিওটি আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি। আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম সেটি নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া ভিডিওতে দেখতে পাওয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের অনেকে চিনেছেন বলে আমাদের তথ্য দিচ্ছেন। আমরাও বিষয়টি নিশ্চিত হতে কাজ করছি।’

মানবজমিন বিস্তারিত অনুসন্ধান

মাত্র ১৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। তাও পুরোটা চোখ মেলে দেখার সাহস পাননি অনেকে। তরুণদের গুলি করে হত্যার পর ভ্যানে স্তূপ করা হয় লাশ। লাশের স্তূপে প্রাণ ছিল এমন মানুষও ছিল। এই ভিডিওটি সামাজিক  যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে জনমনে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কতোটা বর্বর আর নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল তার একটা প্রমাণ হিসেবে হাজির হয়েছে এই ভিডিও চিত্র। শুরুতে ভিডিওর স্থান নিয়ে জিজ্ঞাসা ছিল। তবে গতকাল সকালে নিশ্চিত হওয়া যায় এটি আশুলিয়া থানা এলাকার ঘটনা। ঘটনার বিষয়ে মানবজমিন বিস্তারিত অনুসন্ধান চালিয়ে সেদিনের বর্বরতার আরও অনেক তথ্য পেয়েছে। সেই দিনের ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডে আশুলিয়া থানা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল ছিল সেখানে।

বাংলাদেশের সংকটের ব্যাখ্যা ঘটনাবলী ও সাম্প্রতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ

তাদের গুলিতেই হতাহতের ঘটনা ঘটে। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত পুলিশ সদস্যের অনেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কর্মস্থলে ছিলেন। ভিডিও প্রকাশের পর থেকে তারা আত্মগোপনে চলে যান। ইতিমধ্যে ঘটনায় জড়িত অনেক পুলিশ সদস্যের পরিচয়ও প্রকাশ পেয়েছে।

সরজমিন জানা গেছে, পুলিশের ভ্যানের লাশের স্তূপ করে রাখা মর্মান্তিক ঘটনাটি আশুলিয়া বাইপাইল এলাকার থানা রোডের গলিতে। থানার পাশেই ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টারের দেয়াল ঘেঁষে গুলিবিদ্ধ ৭ শিক্ষার্থীর মরদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। পুলিশ লাশগুলো একত্রিত করে ভ্যানের উপর স্তূপ করে রাখে। এরপরে ঘটে আরও মর্মান্তিক ঘটনা। যার ছবি বা ভিডিও চিত্র ছিল না।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী মানবজমিনকে বলেন, গত ৫ই আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালানোর পরপর বাইপাইল এলাকায় বিজয় মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে বিকালে উত্তেজিত জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করে। এতে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। থানার আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানা ভবনে ঢুকে পড়েন। ঢুকেই তারা থানার গেট বন্ধ করে দেন। তখন বিকাল সাড়ে ৪টা। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলেন। তারা থানা ভবনে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। কেউ কেউ গেট ভাঙতে এগিয়ে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ এ এফ এম সায়েদ পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র রেডি করতে বলেন। গুলি লোড করতে বলেন। এই কথা শুনে  উপস্থিত ছাত্র-জনতা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। আশপাশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় থানা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে সশস্ত্র ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য থানার গেটে অবস্থান নেন। তখন বিকাল ৪টা বেজে ৪০ মিনিট। প্রথমে ওসি সায়েদ গেইটে এসে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। তখন আন্দোলনকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। ছাত্র-জনতা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তখন ওসি এ এফ এম সায়েদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমরা হেরেছি। আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন। সবাই বাড়ি ফিরে যান। একপর্যায়ে এস আই মালেক, ঢাকা উত্তর ডিবির ওসি তদন্ত আরাফাত হোসেন, এসআই মো. রকিবুল, এসআই আবুল হাসান, এসআই হামিদুর রহমান, এসআই নাসির উদ্দিন, এসআই আব্দুল মালেক, এএসআই সুমন চন্দ্র গাইন, এসআই জলিল ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিতে থানার গলিতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। পুলিশের মুহুর্মুহু গুলিতে লোকজন দৌড়ে পালিয়ে যান।

থানার সামনের ভবন থেকে পুরো ঘটনা দেখা রনি আহমেদ নামের এক ব্যক্তি মানবজমিনকে বলেন, বিকালে থানা ফটকের সামনে উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে ১০ থেকে ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। কয়েক মিনিট ধরে ওখানে গোলাগুলি চলে। পরে জীবিত কয়েকজনকে ছাত্ররা নিচু হয়ে এসে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরেও ৬ থেকে ৭ জন ওখানে পড়েছিল। তখন আশপাশের সব অলিগলি জনগণ ঘিরে ফেলে। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওনা হয়। পরে থানা থেকে সব পুলিশ সশস্ত্র হয়ে একযোগে বেরিয়ে আসে। তারা গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসে।

মনিরুল গণভবন থেকে প্রায় ২৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন, যা ছাত্র আন্দোলন দমাতে

পলিমারস অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টার গেটের অপর পাশে সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারি অ্যান্ড মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক ফাহিমা আক্তার মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাটি আমার দোকানের সামনেই ঘটেছে। ৫ই আগস্ট বিকাল সাড়ে ৪টা হবে। সেদিন গুলি খেয়ে থানার গলিতে পড়ে থাকা মরদেহগুলো ভ্যানে তুলছিলেন পুলিশ সদস্যরা। আমাদের চোখের সামনেই তুলেছে। প্রথমে লাশগুলো তুলে ব্যানার দিয়ে ঢেকে থানার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে  আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সেই ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে।

ওইদিন ঘটনাস্থলে থাকা রকি আহমেদ নামের এক পোশাক শ্রমিক মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ প্রথমে গেটে এসেই ইসলাম পলিমারসের সামনে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ ৭ জনকে একটি প্যাডেল ভ্যানে তুলেন। পরে তাদের থানার সামনে আনেন। লাশগুলো থানার পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে তুলে আগুন দেয়া হয়। ৭ জনের লাশ আগুনে পুড়িয়ে থানা থেকে সব পুলিশ বেরিয়ে গলি দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। আর গুলি ছুড়তে থাকে। আগুনে পুড়ে যাওয়া একজনের হাতে তখনো হাতকড়া ছিল।

লাশের স্তূপ করা জায়গাটি হাত দিয়ে দেখিয়ে আসলাম হোসেন নামের এক ব্যক্তি মানবজমিনকে বলেন, ভিডিওতে যে পোস্টারটি দেখা যাচ্ছে। সেটা এখনো দেয়ালে অক্ষত আছে। কিছু বালুর বস্তা ছিল, সেগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেদিন পুরো থানা রোডেই লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পুলিশ ভ্যান নিয়ে সব লাশ এক জায়গায় জড়ো করে। পরে লাশগুলো থানার সামনে এনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনা দেখেনি আশপাশে এমন কোনো মানুষ ছিল না।  এ এক ভয়ানক ঘটনা। মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে।

মীর মাহফুজুর রহমান ‘মুগ্ধ’ শুধুমাত্র একটি নাম নয়, বরং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার উৎখাতে আন্দোলনের আত্মত্যাগের মূর্ত প্রতীক

আশুলিয়া থানার সামনে পুড়িয়ে দেয়া লাশের মধ্য জামগড়া শাহিন স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আস-সাবুরও ছিলেন। নিহত আস-সাবুরের বড় ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে থানার সামনে রাস্তায় পড়ে ছিল। পরে পুলিশ তার নিথর দেহ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পিকআপ ভ্যানে ঢুকিয়ে আগুন দিয়ে দেয়। ভাইটি আমার জীবিত ছিল নাকি মৃত সেটা জানার সুযোগও হয়নি। তারা কোনো সুযোগ দেয়নি। গুলিবিদ্ধ ৭ জনকেই আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। কে জীবিত কে মৃত তাও পুলিশ দেখেনি। আমার ভাই নীল গেঞ্জি পরিহিত ছিল। আমরা গেঞ্জি দেখে পোড়া লাশ শনাক্ত করি।

আফজাল হোসেন নামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, সেদিন পুলিশ থানা থেকে বের হওয়ার সময় কারও কারও হাতে দুটি অস্ত্র ছিল। অনেকে সিভিল ড্রেসে ছিলেন। অনেকের হাতে অচেনা অস্ত্র দেখেছি। তারা গুলি করতে করতে বের হয়। কখনো গুলি বন্ধ করেনি। মেইন রোডে এসে একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন দেয়। ওই পিকআপ ভ্যানেও ৫ থেকে ৬টি গুলিবিদ্ধ মরদেহ ছিল। বিকালে যারা গুলিতে মারা গেছে তাদের ওই ভ্যানেই রাখা হয়েছিল। তারা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল। গুলি কখনো বন্ধ করেনি। অলিগলিতে, রাস্তায়, বাসাবাড়িতে যেখানে খুশি সেখানেই গুলি করেছে পুলিশ। তারা দলবদ্ধ ছিল। ১৩০ জনের বেশি হবে।

বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডের এক অটোরিকশা চালক মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ থানা থেকে মেইন রোডে এসে হাতের ডান- বাম দু’পাশেই গুলি চালিয়েছে। রাস্তার দু’পাশে গুলি চালাতে চালাতে তারা নবীনগরের দিকে আগাতে থাকে। তখন মানুষ জীবন বাঁচাতে যে যার মতো দৌড়ে পালিয়েছে। এক মিনিটের জন্যও পুলিশ গুলি বন্ধ করেনি। যতক্ষণ হেঁটেছে ততক্ষণই তারা গুলি ছুড়েছে। রাস্তার দু’পাশে পথচারী, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের শত শত মানুষ ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়। এমন দিন কখনো দেখেনি বাইপাইলবাসী।

সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আরও কয়েকজন পথচারী মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ থানা রোড থেকে গুলি করতে করতে সোহেল হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। তখন গুলির শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায়নি। চারদিকে মানুষের চিৎকার। বাঁচাও বাঁচাও। মনে হয়েছে যুদ্ধ লেগেছে। তখন মানুষ বাসাবাড়ি ছেড়েও পালাতে শুরু করেন। রাত তখন ৯টার বেশি বাজে। পুলিশ সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। আর গুলি ছুড়ছিল। এভাবে তারা পল্লী বিদ্যুৎ পর্যন্ত চলে যায়। এই সময়ে শত শত মানুষ গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছি।

উদ্বোধনের দীর্ঘদিন পরেও ঝিনাইদহের ২৫ শয্যা বিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল সঠিকভাবে কার্যকর না হয়ে ধীরে ধীরে চলমান

একটি সূত্র মানবজমিনকে জানান, ৫ই আগস্ট সন্ধ্যায় আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ এ এফ এম সায়েদ, ওসি ইনটেলিজেন্স মিজানুর রহমান মিজান, ওসি অপারেশন নির্মল কুমার দাস, ওসি তদন্ত মাসুদুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের ৯০ থেকে ১৩০ জন সদস্য অস্ত্রসহ থানা থেকে বের হয়ে আসেন। বাইপাইলে পুলিশের নির্বিচারের গুলির খবর পেয়ে সাভার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি টহল টিম বাইপাইলের দিকে রওয়া হয়। পল্লী বিদ্যুৎ পার হলে তারাও পুলিশের গুলির মুখে পড়েন। এতে দুই সেনাসদস্য গুলিবিদ্ধ হন। পরে সেনাবাহিনীর একাধিক টিম এসে পুলিশের সকল সদস্যকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ সদস্যদের আটক করে নেন। তখন সবার হাতের আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়। এরপর শত শত মানুষ পুলিশকে ঘিরে ফেলে। পুলিশের কাছে জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর কারণ জানতে চান। জনগণই বিচার করবে বলে পুলিশ সদস্যদের ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এরপর সেনাবাহিনী তাদের নিরস্ত্র করে আটক করে নিয়ে যান। সেদিন রাত ১০টার দিকে নবীনগর সেনানিবাসের গেটে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। পরে সেনাসদস্যরা জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন।

সেদিন অস্ত্র হাতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অস্ত্র হাতে সাধারণ মানুষের উপর গুলি ছোড়েন ওসি তদন্ত মাসুদুর রহমান, এসআই মো. রকিবুল, এসআই আবুল হাসান, এসআই হামিদুর রহমান, এসআই নাসির উদ্দিন, এসআই আব্দুল মালেক, এসআই মো. আরাফাত উদ্দিন, এসআই অমিতাভ চৌধুরী, এসআই সোহেল মোল্লা, এসআই অপূর্ব সাহা, এসআই শরীফ আহম্মেদ, এসআই মো. বদিউজ্জামান, এসআই নোমান সিদ্দিক, এসআই মো. আউয়াল হোসেন, এসআই জোহার আলী, এসআই বিপুল হোসেন, এসআই মো. নুর আলম, এসআই আনোয়ার হোসেন, এসআই মো. সজীব হোসেন, এসআই মো. মোতালেব, এসআই মো. মোস্তফা কামাল, এসআই সিকদার হারুন অর রশিদ, এসআই শিব শংকর, এএসআই মনিরুল ইসলাম, এএসআই আব্দুল জলিল, এএসআই সুমন চন্দ্র গাইন, এএসআই কামরুল হাসান, এএসআই নুরুল ইসলাম, এএসআই আনোয়ার হোসেন, এএসআই ফিরোজ মিয়া সরকার, এএসআই মো. আলাউদ্দিন, এএসআই ইমারত হোসেন, এএসআই এনায়েত হোসেন, এএসআই সিরাজুল ইসলাম, এএসআই মিজানুর রহমান, এএসআই আমির হামজা, এএসআই বিশ্বজিৎ, এএসআই আনুয়ারুল মানার, এএসআই মো. নূর নবী, এএসআই মাসুদ রানা, এএসআই সাহাবুদ্দিন, নায়েক মাহাবুব হোসেনসহ আরও ১০১ জন কনস্টেবল।

সেদিন নিহতের স্বজন ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫ই আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুলিতে অন্তত ৩১ জন নিহত হন। পরদিন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৫ জন মারা যান। এতে ওই ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৪৬ জন। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতাল, আশুলিয়ার হাবিব ক্লিনিক, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাভারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছেন প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ।

তদন্ত কমিটি গঠন:  ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক বর্তমান ঢাকা উত্তর (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভেস্ট পরা যুবকটি আমাদের ঢাকা জেলা গোয়েন্দা বিভাগ উত্তরের পরিদর্শক আরাফাত হোসেন। তিনি বলেন, আরাফাত আমার সঙ্গে কাজ করে। আমি কেন তাকে চিনবো না। ওইটা আরাফাত। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে সে আরাফাত সহ আরও অনেকেই আশুলিয়া থানা পুলিশকে সাপোর্ট দিতে সেখানে যায়। সেদিন সকাল থেকেই আমরা ওখানে ছিলাম। তবে সেদিন ছাত্র-জনতার দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়িনি। তিনি বলেন, আমরা সেদিন ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্‌)  আব্দুল্লাহিল কাফীর নির্দেশনা পালন করেছি। ডিবি’র ওসি বলেন, আরাফাত ঘটনার পর নিয়মিত অফিসও করেছেন। দুই একদিন আগে তার বাবা অসুস্থ হওয়ায় তিনি ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি বরিশালে যান।

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ বলেন, এ বিষয়ে আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটির সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে আরও যাচাই-বাছাই করবেন। আমার বিশ্বাস শুধু আরাফাত নয় পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মধ্যদিয়ে সকল দোষীর নামই উঠে আসবে। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকেই আমরা ছাড় দিবো না। বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অনুসন্ধ্যানে নামে এনটিভি অনলাইন

ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট। গণবিপ্লবের মুখে ততক্ষণে হেলিকপ্টারে করে ভারতের দিকে উড়াল দিয়েছেন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। সেই সংবাদে দেশে তখন উচ্ছ্বাস। আর ঠিক তখনই একটি থানা প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। থানা ঘেরাও করা ছাত্র-জনতার ওপর বৃষ্টির মতো চালানো হয় গুলি। এক সময় জনতা সরে গেলে একে একে ভ্যানের ওপর স্তুপ করা হয় নিথর দেহ। স্তুপ করা দেহের সেই ভিডিও গতকাল শুক্রবার (৩১ আগস্ট) ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এরপর অনুসন্ধ্যানে নামে এনটিভি অনলাইন। জানা যায়, এই ঘটনা আশুলিয়া থানার।

প্রত্যক্ষদর্শীরা সেদিনের নারকীয় অধ্যায়ের বর্ণনা দেন। তাদের দাবি, ভ্যান থেকে নিথর দেহগুলো থানার পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের অন্য একটি পিকআপ ভ্যানে তোলা হয়। এরপর সেই ভ্যানে লাগিয়ে দেওয়া হয় আগুন। নিথর দেহগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। সেদিন থাকা ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল, এসআই মালেক এই গণহত্যা চালান।

প্রত্যক্ষদর্শী নাজমা বেগম এসব তথ্য জানানোর পাশাপাশি জানান, থানা সংলগ্ন ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার্স ফ্যামিলি কোয়াটারের সামনে পড়েছিল গুলিবিদ্ধরা। সেখান থেকে ভ্যানে নিয়ে পরে থানার পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের অন্য একটি পিকআপ ভ্যানে তুলে আগুন দেয় পুলিশ সদস্যরা। তিনি বলেন, ‘গত ২৫ দিনে কতবার যে এমন দৃশ্যের কথা মনে করে ঘুম ভেঙে গেছে তা বলতে পারব না। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’

পুড়িয়ে দেওয়া হতভাগ্যদের মধ্যে ছিলেন, আশুলিয়ায় বৈষম্যবিরোধ ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়া স্কুলছাত্র আস-সাবুর (১৬)। তাকেও ওই স্তুপে তোলা হয়। নিহতের বড়ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, ‘গুলিতে আমার ভাইটা লুটিয়ে পড়ল। দূর থেকে অসহায়ের মতো দেখলাম, পুলিশ ওকে রাস্তা থেকে তুলে ভ্যানে স্তুপ করা অন্য লাশের ওপর ফেলল। তারপর পিকআপ ভ্যানে স্থানান্তর করে সেখানে আগুন ধরিয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল, তখনও জীবিত মারা যায়নি। আদরের ছোট ভাইটাকে মনে হয় জীবন্তই পুড়িয়ে মারল।’

অপর প্রত্যক্ষদর্শী মোবারক হোসেন জানান, মনে হচ্ছিল, পুলিশ উন্মাদ হয়ে গেছে। যাকে সামনে পাচ্ছে, তাকেই গুলি করছে। চোখের সামনে দেখলাম পাখির মত মানুষ মারতে। বেশ কিছুক্ষণ পর বীভৎস গন্ধ টের পেলাম। পরিস্থিতি শান্ত হবার পর কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম, অনেকগুলো পোড়া লাশের স্তুপ। থানা ছেড়ে পালিয়েছে পুলিশও।

এমন ঘটনা যে থানার, সেই থানার দায়িত্বে তখন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ। সম্প্রতি তাকে বদলি করা হয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে। সেদিনের ঘটনার সম্পর্কে এ এফ এম সায়েদ বলেন, আমার পরিবার ছিল থানার ওপরে কোয়ার্টারে। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই আমি আমার পরিবারকে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে বলি। পরিস্থিতি এমন ছিল যে আত্মরক্ষার জন্য গুলি করা ছাড়া আমাদের সামনে আর বিকল্প কিছু ছিল না। তবে, আমরা যেটাই করেছি, সেটা ওপরের নির্দেশেই করেছি। এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে আপনারা কাফী স্যারকে করেন।

বাংলাদেশের সংকটের ব্যাখ্যা ঘটনাবলী ও সাম্প্রতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ

জানা গেল এই কাফী মানে ইউনিট কমান্ডার হিসেবে সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থানার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্ ও ট্রাফিক, উত্তর বিভাগ) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভাই, আমি সেদিন সাভারেই যাইনি, কীভাবে অর্ডার দেব?

২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর কাফী যোগ দেন ঢাকা জেলা পুলিশে। সূত্রমতে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলে সাফি মোদ্দাসের খান জ্যোতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ২৯ বিসিএসের (পুলিশ) এই কর্মকর্তা। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথিত ছেলে হিসেবেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে সমীহ করে চলতেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের গতিপথ নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করে নানা সূত্রে আব্দুল্লাহিল কাফী টের পেয়েছিলেন সরকারের পতন সময়ের অপেক্ষামাত্র। ওসি এ এফ এম সায়েদের দাবি, কাফীই প্রতিটি মুহূর্তে ওয়ারলেসে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আব্দুল্লাহিল কাফী বলেন, ওদিন আমি সাভারে যাইনি। আমার হাতে ওয়ারলেসও ছিল না। আমি কীভাবে নির্দেশ দিলাম? অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একটু বেলা করেই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। গাবতলীর কাছে পৌঁছে পরিস্থিতির বেগতিক দেখে নিরাপদে চলে গিয়েছিলাম।’

কাফীর এমন সব উত্তরে আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদের কাছে আবারও জানতে চাওয়া হয় ঘটনা সম্পর্কে। তিনি বলেন, এটা মিথ্যা কথা। স্যার আমাদের নিজে ওয়ারলেসে নানা সময় নানা নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা তো ভেবেছি, স্যার সাভারে বসে আমাদের এসব নির্দেশনা দিচ্ছেন।

একইকথা বলেছেন, ঢাকা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ (বিপ্লব)। তিনি বলেন, আমরা তো কাফী স্যারের কমান্ডেই চলেছি। উনি তো সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে ওয়ারলেস যুক্ত ছিলেন।

শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর সাভারে দেখা যায়নি আব্দুল্লাহিল কাফীকে। সম্প্রতি ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামানকে বদলি করা হয় সারদা পুলিশ একাডেমিতে। তার স্থলে যোগ দেন পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ।

গত ২৯ আগস্ট সকালে ঢাকা জেলা পুলিশের নবাগত পুলিশ সুপার যোগদান উপলক্ষে বিশেষ কল্যাণ ও মতবিনিময় সভায় পুলিশ সুপারদের পাশেই দেখা উদয়া হন শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন হত্যা মামলার আসামি এই আব্দুল্লাহিল কাফী।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৮ জুলাই সাভারে পুলিশের গুলিতে প্রথম নিহত হন মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) শিক্ষার্থী ইয়ামিন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২৫ আগস্ট ইয়ামিনের মামা আব্দুল্লাহ আল কাবির ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলামের আদালতে হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। ওই মামলায় কাফীসহ ৪৯ জনকে আসামি করা হয়। এ বিষয়েও পুলিশ সদর দপ্তর নিবিড় অনুসন্ধান করছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

অনুসন্ধ্যানে কালেরকন্দট

ভিডিওর ১ মিনিট ৬ সেকেন্ডে একটি পোস্টার দেখা যায়, যা স্থানীয় যুবলীগের ধামসোনা ইউনিয়ন সভাপতি ও ৯ নম্বর চৌরাওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেনের। সেই পোস্টারটি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ভিডিওটির ঘটনাস্থল আশুলিয়া থানার পাশে।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের পেছনের সড়ক দিয়ে থানা রোড অতিক্রম করে এসবি অফিসের দিকে যাওয়ার সময় ডান পাশের দেয়ালটি হুবহু ভিডিওর সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে। ওখানে এখনো সেই পোস্টারটি দেয়ালে রয়েছে। মহাসড়ক থেকে থানার দিকে অগ্রসর হয়ে এসবি অফিসের দিকে চৌরাস্তায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে ওই বাড়ির একাধিক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা বললেও ভিডিওর ব্যাপারে জানা যায়নি।

জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট সকাল থেকেই নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকায় জড়ো হতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীরা। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার খবরে আন্দোলনকারীরা থানার চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলে। এ সময় পুলিশ মসজিদের মাইক ও হ্যান্ডমাইক দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের পরেও আন্দোলনকারীরা থানার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এ সময় পুলিশ গুলি চালাতে থাকে। তখন তারা দোকান বন্ধ করে নিরাপদ স্থানে সরে যান।

এ ব্যাপারে আশুলিয়া থানার একাধিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে কেউ মুখ খোলেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, ঘটনাটি বিকেল ৪টার দিকে ঘটেছে। এ সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আন্দোলনকারীরা থানায় হামলার চেষ্টা করলে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। তবে ভ্যানে লাশ স্তূপ করার ঘটনাটি তিনি দেখেননি বলে জানান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈন বলেন, আজ সকালে ভিডিওটি আমি দেখেছি। এটি অ্যানালিসিস করা হচ্ছে। আপনারা যেহেতু মিডিয়ায় কাজ করেন, কোনো তথ্য কিংবা সূত্র পেলে আমাদের সহযোগিতা করার অনুরোধ করছি।

 

shoberkotha

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version