বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং কোটা সংস্কারের দাবিতে আবু সাঈদসহ তরুণ শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনের কারণেই আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন, যা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

আবু সাঈদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর মৃত্যু দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ এবং বিক্ষোভের সৃষ্টি করে, বিশেষত শিক্ষার্থী মহলে। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র আন্দোলন আরও তীব্র হয়, যার ফলে সরকারের ওপর চাপ বেড়ে যায় এবং পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনকে ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা

হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট:

কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের এক সময়ের অন্যতম বড় সামাজিক আন্দোলন। এটি প্রথম শুরু হয় ২০১৮ সালে, যখন শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কার দাবি করে। শিক্ষার্থীদের মূল দাবি ছিল, সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হোক এবং কোটার সংখ্যা কমানো হোক। কিন্তু এই দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ও প্রশাসন থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই স্বপ্নগুলো কবর হয়ে গেল রবিউলের মৃত্যুর সঙ্গে।

আবু সাঈদ এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৬ জুলাই ২০২৪ সালে, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এক নিরস্ত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা জনমনে বিশাল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ করে এবং আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে।

মামলার অগ্রগতি:

আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী ১৮ আগস্ট রংপুর অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৭ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তাজহাট থানায় এজাহার হিসেবে নেওয়া হয়। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয় যে, পুলিশ পূর্বপরিকল্পিতভাবে এবং নির্দয়ভাবে আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করেছে, যদিও তিনি পুলিশের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন না।

মাকে বলেছিলেন, “আমরা দেশ বদলাতে যাচ্ছি মা, আমি আসব, তুমি চিন্তা করো না।” কিন্তু সেই আসা আর হলো না।

আদালতে মামলার শুনানির সময় উল্লেখ করা হয়, দুই পুলিশ সদস্য আমির হোসেন এবং সুজন চন্দ্র রায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে আবু সাঈদকে গুলি করেছেন। এই কারণে তাঁদের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রিমান্ড চেয়ে আবেদন করলে আদালত এই আদেশ দেন।

অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিস্থিতি:

এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে দুই পুলিশ সদস্য আমির হোসেন এবং সুজন চন্দ্র রায় সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এবং তাঁদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তবে মামলায় আরও বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গও অভিযুক্ত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে রংপুরের সাবেক উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আবদুল বাতেন, রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানসহ আরও অনেকে আছেন।

শেখ হাসিনার বাধ্যতামূলকভাবে গণভবন ছাড়ার ঘটনা, জাদুঘর ও ইতিহাস

রংপুর রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি আবদুল বাতেন এবং রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও অভিযুক্ত করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মশিউর রহমান এবং লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মণ্ডল উল্লেখযোগ্য। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকেও মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।

আন্দোলনের প্রভাব:

আবু সাঈদের মৃত্যুর পর কোটা সংস্কার আন্দোলন আরও বেগবান হয়। শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার করতে হবে এবং কোটা সংস্কারের দাবিগুলো পূরণ করতে হবে। দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ এবং র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়, যাতে লাখো শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ অংশ নেন।

এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘটনা এই আন্দোলনেরই ফলাফল বলে মনে করা হচ্ছে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তিনি ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন। শিক্ষার্থীরা এই ঘটনাকে আন্দোলনের একটি বড় সফলতা হিসেবে দেখছেন, যদিও আবু সাঈদের মৃত্যু তাঁদের জন্য এক বড় ক্ষতি।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া:

আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। একদিকে শিক্ষার্থীরা তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে কিছু অংশ সরকারের পদক্ষেপের সমর্থনে অবস্থান নিয়েছে। তবে দেশের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ এবং সুশীল সমাজ এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে এবং আবু সাঈদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনকে ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবু সাঈদের হত্যার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর থেকে সারা দেশে একটি আন্দোলনের ঢেউ তৈরি হয়। এই ভিডিওতে দেখা যায়, একজন নিরস্ত্র তরুণকে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে, যা জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানো হয় এবং তার বিচার দাবি করা হয়।

সরকারের অবস্থান:

সরকার শুরুতে এই আন্দোলনকে অবমূল্যায়ন করে এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। তবে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভ এবং জনমনে তৈরি হওয়া ক্ষোভের কারণে সরকারকে কোটা সংস্কারের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হয়। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার কোটা পদ্ধতির সংস্কারের কথা ঘোষণা করে, তবে এটি আন্দোলন থামাতে পারেনি।

সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের গ্রেপ্তার ও ৭ দিনের রিমান্ড

আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ব্যাপারে সরকার শুরুতে ধীরগতিতে কাজ করলেও, পরবর্তীতে পুলিশ সদস্যদের বরখাস্ত এবং তাঁদের রিমান্ডে নেওয়ার মাধ্যমে তদন্তের গতি কিছুটা বাড়ানো হয়। তবে অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার এখনও হয়নি এবং সরকার পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য কিছু প্রতীকী পদক্ষেপ নিয়েছে মাত্র।

আবু সাঈদের পরিবার:

আবু সাঈদের পরিবার এখনো এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার পায়নি। তাঁর বড় ভাই রমজান আলী আদালতে মামলা করার পরও বিচার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে এগোচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। আবু সাঈদের মা-বাবা তাঁদের ছেলের হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার চান এবং তাঁরা আশা করছেন যে, তাঁদের ছেলে একটি আন্দোলনের শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।

আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, ‘আমরা চাই আমার ভাইয়ের হত্যার সঠিক বিচার হোক। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিল। সে কোনো অপরাধী ছিল না। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, এবং আমরা এর সঠিক বিচার চাই।’

উপসংহার:

আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর মৃত্যু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছে এবং দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আগুন জ্বালিয়েছে। যদিও তাঁর পরিবার এখনও ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে, তবে তাঁর মৃত্যু একটি বড় সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে থাকবে।

এই হত্যাকাণ্ড এবং এর পরবর্তী ঘটনা বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং প্রশাসনিক অবকাঠামোর অসামঞ্জস্যতাগুলোকে প্রকাশ করে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন এবং আবু সাঈদের মৃত্যু দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শিক্ষণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে, যেখানে তাঁরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রেরণা খুঁজে পাবে।

shoberkotha

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version