ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ঘটে যাওয়া দুইটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এই দুই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ছাত্র শিবির কর্মী শামীম হোসেন (২১) ও আবুজার গিফারী (২২)। তাদের পরিবারের সদস্যরা ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার ঝিনাইদহের আমলী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় তৎকালীন ঝিনাইদহের পুলিশ সুপারসহ ৮ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও দুইজন সাবেক পৌর মেয়রসহ মোট ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ঝিনাইদহে পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৩ জন বিপুল পরিমাণ ফেন্সিডিলসহ আটক

শামীম হোসেনের ঘটনা: ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ, বিকেল ৫টার দিকে সরকারি মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের পূর্ব পাশের গেটের সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চারজন সাদা পোশাকের সদস্য দুইটি মোটরসাইকেলে এসে শামীম হোসেনকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। এরপর ২০ দিন পর ১৩ এপ্রিল যশোর জেলার হৈবতপুর ইউনিয়নের লাউখালী বিরাম পুকুর থেকে তার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

আবুজার গিফারীর ঘটনা: অন্যদিকে, ২০১৬ সালের ১৮ মার্চ দুপুর ২টার দিকে আবুজার গিফারীকে তার বাড়ির সামনে থেকে দুইটি মোটরসাইকেলযোগে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। ১৩ এপ্রিল যশোর জেলার একই স্থানে তার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়।

ঝিনাইদহে দুই মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

দুটি মামলায়ই পুলিশের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। শামীম হোসেনের মামলায় ঝিনাইদহের তৎকালীন পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন চৌধুরীসহ ১২ জন এবং আবুজার গিফারীর মামলায় ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো:

  1. পুলিশ কর্মকর্তারা:
    • আলতাফ হোসেন (সাবেক পুলিশ সুপার)
    • আজবাহার আলী শেখ (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার)
    • এসআই নিরব হোসেন
    • এসআই শরাফুল আলম
    • এসআই ইমরান হোসেন
    • এসআই গাফফর হোসেন
    • এসআই নাসির হোসেন
  2. স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব:
    • শিবলী নোমানী (সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান)
    • আশরাফুল আলম (সাবেক মেয়র)
    • মোস্তাফিজুর রহমান বিজু (সাবেক মেয়র)
    • আব্দুর রউফ (সাবেক এমপির ব্যক্তিগত সহকারী)
    • আলী হোসেন অপু (রায়গ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান)
    • মহিদুল ইসলাম মন্টু (রাখালগাছী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান)
    • আবুল কালাম আজাদ (বারোবাজার ইউপি চেয়ারম্যান)

এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। অনেক মানবাধিকার সংগঠন, আইনজীবী ও সাধারণ মানুষ এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে আসছেন। শামীম হোসেন ও আবুজার গিফারীর হত্যাকাণ্ডকে “বন্দুকযুদ্ধের” আড়ালে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, তাদের সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আইন ও বিচার বিভাগের প্রতি আস্থার সংকটও রয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষ মনে করেন পুলিশ বাহিনীর অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পাওয়া খুবই কঠিন।

শ্যামল দত্ত, মোজাম্মেল বাবু ও শাহরিয়ার কবির ৭ দিনের রিমান্ডে

কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আবু আজিফ জানান, আদালতের কপি হাতে পেলে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদালত ১৫৬ (৩) ধারার বিধান মোতাবেক এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন, যা প্রমাণ করে আদালত এই মামলাকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনও জানা যায়নি। তবে আগের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, সাধারণত এ ধরনের মামলায় পুলিশ নিজস্ব তদন্তের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তাছাড়া, সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার কারণে প্রশাসনিক তদন্তও পরিচালিত হতে পারে।

হত্যা মামলা দায়েরের ঘটনায় সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি

বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার মামলাগুলিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  1. সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব: অনেক সময়ই যথেষ্ট প্রমাণ না থাকায় মামলাগুলি দীর্ঘায়িত হয় এবং আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়।
  2. প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভূমিকা: পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের প্রভাবের কারণে মামলা পরিচালনা ও তদন্তে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
  3. জনমত ও মিডিয়ার ভূমিকা: এ ধরনের মামলাগুলিতে গণমাধ্যমের প্রচার ও জনমতের প্রভাব রয়েছে। তবে বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ায় জনমতের চেয়ে তথ্য-প্রমাণ ও আইনকানুনের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
  4. মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভূমিকা: আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপ প্রয়োগ এবং তাদের পর্যবেক্ষণ বিচার প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এবং স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা এ ধরনের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে থাকে। তারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় এবং একটি স্বচ্ছ তদন্তের দাবি করে। তারা মনে করে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে।

সাবেক সংসদ সদস্য নায়েব আলী জোয়ার্দারকে যৌথ বাহিনী রাজনৈতিক সহিংসতা ও নাশকতার অভিযোগে গ্রেপ্তার

এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:

  1. স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত: আদালতের নির্দেশে একটি স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি গঠন করে নিরপেক্ষভাবে এই ঘটনার তদন্ত করা যেতে পারে।
  2. মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা: জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে এই মামলার উপর নজরদারি রাখতে হবে এবং তদন্ত প্রক্রিয়াকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
  3. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মিডিয়া এবং নাগরিক সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  4. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ: আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় একটি স্বচ্ছ তদন্ত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা যেতে পারে।

ঝিনাইদহে শামীম হোসেন ও আবুজার গিফারীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামের একটি উদাহরণ। এই মামলার রায় কেবল ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর জন্যই নয়, বরং বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হতে পারে। বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি সত্যিই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি দৃঢ় বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে।

এর ফলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটার পূর্বে সংশ্লিষ্টরা আরও সচেতন হবেন এবং দেশের জনগণ আইনের প্রতি আরও আস্থাশীল হবে।

shoberkotha

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version