ঝিনাইদহে সবজির বাজারে আগুন লেগেছে, আর সেই আগুনে পুড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রা। কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর থেকে শুরু করে চাকরিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও সবজির উর্ধ্বমূল্যে দিশেহারা। দাম বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মানুষ বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছে না। হতাশা ও ক্ষোভে তাদের মুখে চাপা কান্না, যা দেখে মনে হয়, তাদের কষ্টের কেউ সুরাহা করতে আসছে না। নিম্ন আয়ের মানুষদের এই দুরবস্থায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
বিগত জালিম সরকারের সিন্ডিকেট এখনও বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে: জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান
ঝিনাইদহ জেলার ছয়টি উপজেলায় এ অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। পেঁয়াজ, রসুন, আলু থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজির দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মরিচ ৩২০ টাকা, টমেটো ১৮০ টাকা, বেগুন ১৫০ টাকা, ঢেঁড়শ ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এমনকি পুইশাক ও লালশাকের দামও এতটাই বেড়েছে যে সেগুলোও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শুধুমাত্র এক থেকে দেড় মাসের ব্যবধানে এই দাম বৃদ্ধি দেখা গেছে, যা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। অভিযোগ আছে, পাইকারি বাজার থেকে স্বাভাবিক দামে সবজি কিনে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা খুচরা ক্রেতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করছেন।
রোববার সকালে সরেজমিনে শহরের নতুন হাটখোলার কাঁচা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সবজি বিক্রেতারা প্রতি কেজি মরিচ ৩২০, টমেটো ১৮০, বেগুন ১৫০, ঢেঁড়শ ১২০, উস্তে ১২০, পটল ১০০, মুলা ১০০, ফুলকপি ১৫০, পাতাকপি ৯০, আমড়া ১২০, শষা ৯০, গাজর ১০০, মুখিকচু ৮০, কাবিল কচু ৬০, বুনো কচু ৬০, মেটে আলু ৮০, কাকরোল ১৫০, পেঁপে ৬০, উষি ৮০, ধুন্দল ৭০, ঝিংগা ৮০, কচুরলতি ৭০, ওল ৮০, মিষ্টি কুমড়া ৮০, লাউ ৭০, সিম ২৫০, পুইশাকের মেছরি ১৩০, বড়বটি ১০০, আলু ৬০, পিয়াজ ১৩০, রসুন ২৫০, আদা ১৬০ ও শুকনা মরিচ ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।
বর্তমান সময়ে (২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে) কৃষিপণ্যের চড়া পাইকারী ও খুচরা বাজারদর।
এ ছাড়া প্রতি আঁটি লাল শাক ৩০, পুইশাক ৩০, কলমী শাক ২৫, শাপলা ফুলের লতি ৬০, কাবিল কচুর ডাটা ৩০, ডাটা ৪০, ধনিয়া পাতা শ ১০০ টাকা ও প্রতিহালি কাঁচা কলা ৪০ টাকা এবং লেবু হালি ৪০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাম্প্রতিক বৃষ্টি এবং খরার কারণে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। লাগাতার বৃষ্টি এবং বৈরী আবহাওয়ার কারণে সবজির ক্ষেত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা বাজারে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করেছে। তাই তারা বেশি দামে সবজি কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের মতে, বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই, মূলত ফসলের ঘাটতির কারণেই দাম বেড়েছে।
দিনমজুর ও ভ্যানচালকদের অবস্থা আরও করুণ। একজন দিনমজুর প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করে, যা দিয়ে দৈনিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনা তো দূরের কথা, সংসার চালানোই দুরূহ হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির কারণে কাজ বন্ধ থাকলে তারা ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হয়, ফলে দেনা করে দিন পার করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে গিয়ে সবজি, ডিম, মাছ বা মাংস কেনা একপ্রকার বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির দুয়ার খুলতে পারলে বদলে যাবে বাংলাদেশের ওষুধ খাত
ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির পেছনে সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে, আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো মনিটরিং করা হচ্ছে না। বাজারে কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে নিচ্ছেন। প্রশাসনের হস্তক্ষেপের অভাবে সিন্ডিকেটগুলো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। বাজারে মনিটরিং করলে হয়তো সিন্ডিকেটের প্রভাব কমবে, কিন্তু তেমন কোনো পদক্ষেপ এখনো চোখে পড়ছে না।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আয় অনুযায়ী ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকেই বাজারে এসে হাত খালি ফিরে যাচ্ছেন, কারণ তাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই।
এদিকে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিয়া আক্তার চৌধুরী জানিয়েছেন, সবজি বাজার মনিটরিং করার কাজ চলছে এবং বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে এতে দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আওয়ালও জানিয়েছেন, অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তবে তাতে কতটা পরিবর্তন আসবে তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ।
কৃষকরা বলছেন, এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। সবজির ফলন কম হওয়ায় বাজারে দাম বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারা লাভবান হচ্ছে না, বরং ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে তারা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মাছের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বৃষ্টির কারণে অনেক স্থানে মাছের খামারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফলে মাছের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাবলু নামের এক ক্রেতা বলছেন, বাজারে গেলে বোঝা যায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কেমন মাত্রা যোগ হয়েছে। ১ হাজার টাকার নোটে ৩/৪ আইটেম পণ্য নিলে ফুরিয়ে যায়। মানুষের জীবনযাপনে খুবই কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে যারা দিনমজুর নি¤œ আয়ের মানুষ তাদের অনেক কষ্টে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। সিন্ডিকেটের কারণে মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। জবাবদিহিতা করার কেউ নেই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন চোখে পড়ার মতো মনিটরিং করা হচ্ছে না।
ঢাকার মেট্রোরেল ভাড়ার তুলনামূলক বিশ্লেষণ: আঞ্চলিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট
আলমঙ্গীর হোসেন নামের দিনমুজুরী অন্য ক্রেতা বলেন, আমাদের মতো গরীব মানুষের সবচেয়ে বড় জ্বালা। যা ইনকাম করি তা দিয়ে কোন রকম ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা যেন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। মাছ ও মাংস তো মাসে ১দিন কিনতে হিমসিম খাই। ঘরে ছোট তিন ছেলে-মেয়ে তারাও নিয়মিত ডাল দিয়ে খেতে চাই না। তারা মাছ ও মাংসের জন্য বায়না ধরে। সেকারণে অনেক কষ্ট করে হলেও সাধ্য অনুযায়ী কেনার চেষ্টা করি। চলমান পরিস্থিতিতে আমাদের মতো গরীবের হয়েছে যত জ্বালা যেন আমাদের দেখার কেউ নেই।
সাধারণ জনগণের দাবি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সিন্ডিকেট ভেঙ্গে বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার। ক্রেতারা বলছেন, বাজারে নিয়মিত মনিটরিং করা হলে, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতে পারে, যা দাম স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হবে। তবে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে, এতে তাদের হাত নেই।
সবমিলিয়ে, ঝিনাইদহের সাধারণ জনগণ এক কঠিন সময় পার করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।