সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে যাত্রাবাড়ীতে দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনায় দুটি মামলা দাখিল করা হয়, যার পেছনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিশোধমূলক কার্যক্রম থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর, সাকিব হাসান এবং জাহাঙ্গীর আলম নামের দুজন নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মামলাগুলোর এজাহারে উল্লেখিত আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ঢাকা জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন পরিচালক, একজন উপপরিচালক, এবং একজন সহকারী পরিচালককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মামলাগুলোর পেছনে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা নবী উল্লাহ এবং তার জামাতা সিরাজউদ্দৌলার ভূমিকা রয়েছে, যারা স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খান ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গ্রেপ্তার
বিএনপি নেতা নবী উল্লাহর জামাতা সিরাজউদ্দৌলা অনুমোদনবিহীনভাবে মাতুয়াইলে একটি হিমাগার চালু করেছিলেন, যা ২০২০ সালে জেলা প্রশাসনের অভিযানে ধরা পড়ে। অভিযানে সিরাজউদ্দৌলাকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এই অভিযানকে সমর্থন করেছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা ছাড়পত্র ছাড়াই হিমাগারটি পরিচালনা করছিলেন এবং অভিযোগ অনুযায়ী তার কার্যক্রমে অনেক অনিয়ম ছিল। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর নবী উল্লাহ এবং তার পরিবার এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
ফরিদপুরে অতিরিক্ত মদ পানে আরও এক স্কুলছাত্রীর মৃত্যু
মামলার এজাহারে দেখা যায়, যেসব সরকারি কর্মকর্তারা হিমাগার বন্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের নাম তালিকায় দেওয়া হয়েছে। মামলায় আসামিদের তালিকায় উল্লেখিত কর্মকর্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে রয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রফিকুল হক, পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোক্তাদির হাসান, এবং উপপরিচালক ইলিয়াস মাহমুদ। এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মাসুদ হাসান পাটওয়ারী, যিনি নবী উল্লাহর আরেক জামাতা ছিলেন, তাকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে। যদিও মাসুদ হাসানের দাবি, তার নবী উল্লাহর মেয়ের সাথে ২০১৮ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এবং তিনি ২০২১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরে যোগ দেন, তখন থেকে হিমাগারের ঘটনার সাথে তিনি কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন না। তার ভাষ্যমতে, তাকে পুরনো পারিবারিক বিরোধের জের ধরে ফাঁসানো হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক মামলাগুলো সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলাগুলো পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির নেতারা দাবি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আমলে যেভাবে মিথ্যা গায়েবি মামলা দেওয়া হতো, তেমনি বর্তমানে বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে এসব মামলা দায়ের করছেন। এর ফলে নির্দোষ ব্যক্তিরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে দুর্ঘটনায় স্পিডবোট ডুবে ৯ জন র মধ্যে ৮ জন উদ্ধার একটি শিশু নিখোঁজ
সাকিব এবং জাহাঙ্গীর হত্যা মামলায় দেখা যায়, বাদী হিসেবে নাম উল্লেখ করা হয়েছে বিএনপির নেতা আবু বক্করের। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আবু বক্কর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের আহ্বায়ক এবং তিনি নবী উল্লাহর অনুসারী। মামলার বাদী হিসেবে আবু বক্কর দাবি করেন, মাঠের আন্দোলন-সংগ্রামে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল, যা তাকে মামলার বাদী হতে উৎসাহিত করেছে। তবে মামলায় যেসব ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের অনেকের সাথেই ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এমনকি মামলার এজাহারে ৪৪২ জন করে দুই মামলায় মোট ৮৮৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তা।
মামলার প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যারা মামলা পরিচালনা করছেন বা বাদী হয়েছেন, তারা অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠছে যে, মামলা করতে বাদীদের টাকা পয়সা দিয়ে ‘খরচা’ করে ইচ্ছেমতো আসামির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মামলায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়াটি অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক শত্রুতার প্রতিফলন বলে মনে হচ্ছে।
সংশোধিত – নিউজ মামলায় হেরেও অন্যের জমি দখল করলেন সাবেক পৌর কাউন্সিলর
মিরপুরে রিতা আক্তার নামের এক কিশোরীর হত্যা মামলার এজাহারে দেখা যায়, বিএনপির কিছু নেতার নির্দেশে বাদী তার সই করেছেন এবং আসামিদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। মামলায় আসামিদের মধ্যে স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও আছেন, যারা মূলত রাজনৈতিকভাবে বিরোধী মতের হওয়ায় তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা দাখিলের যে প্রবণতা ছিল, তা নতুনভাবে ফিরে এসেছে। তবে এই ধারা এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে, যেখানে বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা মামলায় আসামি করা হচ্ছে। মামলা হওয়ার পর অভিযোগ উঠছে যে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে এসব মামলা ব্যবহার করছেন।
ঢাকার আশেপাশের শিল্প এলাকায় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও এমন মামলার উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন পেশার মানুষ যেমন সাংবাদিক, শিল্পী, খেলোয়াড় এবং নাগরিক আন্দোলনকর্মী পর্যন্ত মামলায় আসামি করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব মামলার উদ্দেশ্য চাঁদাবাজি এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ব্যক্তিদের থেকে অর্থ আদায় করা।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের বিষয়ে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে এবং এসব মামলায় যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে এ ধরনের মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগের ছয় বিচারপতি সাক্ষাৎ
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের আইনি প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এ কারণে নির্দোষ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এজন্য আইনি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা জরুরি।
মামলার ভিত্তিহীনতা প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্ট বাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে কেউ আইনকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।