ঝিনাইদহ শহরের একটি জমি নিয়ে দীর্ঘ ৩৭ বছরের বিরোধকে কেন্দ্র করে আদালতের রায় এবং পুলিশের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে বিএনপি নেত্রী ফারহানা রেজা আঞ্জুর বিরুদ্ধে। এই জমি দখলের ঘটনাটি ঝিনাইদহ শহরের কাঞ্চননগর মৌজায় অবস্থিত একটি ১২ শতকের জমিকে ঘিরে। জমিটির মালিকানা নিয়ে শুরু হওয়া মামলাটি অনেক বছর ধরে চলতে থাকা এক জটিল এবং বিতর্কিত ঘটনা, যেখানে জমির মূল মালিকরা বারবার আদালতের রায় পেলেও জমি দখলের সমস্যা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না।
৩৭ বছর ধরে মামলা চালিয়েছেন। বৈধ কাগজপত্রের অভাবে নি¤œ আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত হেরেও গেছেন। তারপরও পিছু ছাড়ছেন না ঝিনাইদহ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ফারহানা রেজা আঞ্জু। আদালতের রায় উপেক্ষা করে পরের জমিতে তুলছেন স্থাপনা। এক্ষেত্রে তিনি পুলিশ ও আদালতের কোন বিধি নিষেধ মানছেন না। জমি দখলের এই ঘটনাটি ঘটেছে ঝিনাইদহ শহরের ১৯৭ নং কাঞ্চননগর মৌজায়।
ঝিনাইদহে ৩ কৃষকের ২ বিঘা জমির পান বরজ কেটে দিয়েছে দুর্বত্তরা
এই জমি নিয়ে মামলা শুরু হয় প্রায় ৩৭ বছর আগে, যখন সাবেক পৌর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন মশার স্ত্রী তৌহিদা খাতুন এবং তার বোন ফরিদা খাতুন নিলামের মাধ্যমে কাঞ্চননগর মৌজার ১২ শতক জমি আদালতের মাধ্যমে ক্রয় করেন। তবে জমিটির পৈতৃক দাবি তুলে বিএনপি নেত্রী ফারহানা রেজা আঞ্জু এবং তার পরিবার আদালতে মামলা দায়ের করেন। এই মামলাটি ঝিনাইদহের নি¤œ আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হয়।
এরপর ঝিনাইদহ যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিজ্ঞ বিচারক তৌহিদা খাতুন এবং ফরিদা খাতুনের পক্ষে রায় প্রদান করেন। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশের উপস্থিতিতে জমির ওপর থাকা দখলকৃত স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করে প্রকৃত মালিকদের জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
যদিও আদালতের রায়ে জমির মালিকানা তৌহিদা খাতুন এবং ফরিদা খাতুনের পক্ষে নির্ধারিত হয়েছিল, দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ফারহানা রেজা আঞ্জু আবারও জমির ওপর অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন বলে অভিযোগ উঠে। তৌহিদা খাতুন ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবে এক লিখিত অভিযোগে দাবি করেন, বিএনপি করার কারণে আঞ্জু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জোরপূর্বক জমি দখল করছেন এবং আদালতের রায় উপেক্ষা করছেন। তৌহিদা খাতুন আরও উল্লেখ করেন যে, তার পরিবার এই রাজনৈতিক প্রভাবের সামনে অসহায় হয়ে পড়েছে এবং তারা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তার ৮, পাঁচজন বিভিন্ন বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য : র্যাব
এই জমি দখলের ঘটনার প্রেক্ষিতে ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়, যেখানে জমি দখলের অভিযোগ তুলে ধরা হয়। অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে জমিতে চলমান নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় এবং উভয়পক্ষকে আদালতের রায় মেনে চলতে নির্দেশ দেয়। তবে তৌহিদা খাতুনের ছেলে অ্যাডভোকেট মাজহার সবুজ অভিযোগ করেন যে, পুলিশ নির্মাণ কাজ বন্ধ করার পরও কিছু সময় পর তা পুনরায় শুরু করা হয়েছে। এই নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
অন্যদিকে, জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপি নেত্রী ফারহানা রেজা আঞ্জু দাবি করেন যে, জমিটি তার পৈতৃক সম্পত্তি এবং আদালতের রায়কে প্রভাবিত করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। তারা তঞ্চকতার মাধ্যমে রায় নিয়েছেন।” আঞ্জু আরও জানান যে, তার দাবি অনুযায়ী জমির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও আদালত তা বিবেচনা করেনি এবং তিনি নিজেই এই মামলায় ভুক্তভোগী হয়েছেন বলে মনে করেন।
ঝিনাইদহ সদর থানা ও সেনা ক্যাম্পে পাঠানো এক অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, ঝিনাইদহ শহরের গীতাঞ্জলী সড়কের সাবেক পৌর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসে মশার স্ত্রী তৌহিদা খাতুন ও ফরিদা খাতুন কাঞ্চননগর মৌজার অধীনে ১২শতক জমি নিলামের মাধ্যমে আদালতের মধ্যস্থতায় ক্রয় করেন। এ নিয়ে মামলা করেন জমির ওয়ারেশ বিএনপি নেত্রী ফারহানা রেজা আঞ্জুরা। দীর্ঘ ৩৫ বছর আদালতে মামলা চলতে থাকে।
কুড়িগ্রামে মহানবী (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তি করায় গ্রেপ্তার ২
এই জমি দখলের ঘটনা শুধু একটি জমি নিয়ে বিরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি স্থানীয় রাজনীতির সাথে জড়িয়ে আছে। ফারহানা রেজা আঞ্জু একজন বিএনপি নেত্রী এবং তিনি ঝিনাইদহ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করেছেন। তার রাজনৈতিক প্রভাব এবং দলের সমর্থনের কারণে এই জমি বিরোধের বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তৌহিদা খাতুনের অভিযোগ থেকে বোঝা যায় যে, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে এবং এর ফলে প্রকৃত জমির মালিকরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এই ঘটনার মাধ্যমে সমাজে একটি বৃহত্তর প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে: রাজনীতি এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কীভাবে আদালতের রায় উপেক্ষা করে সমাজে নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারে? আইন এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন আদালতের রায় সঠিকভাবে কার্যকর হয় না?
ঝিনাইদহ যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিজ্ঞ বিচারক তৌহিদা খাতুন ও ফরিদা খাতুনের পক্ষে রায় দেন। মামলার রায় পেয়ে ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশ এসে দখলকৃত স্থাপনা উচ্ছেদ করে জমির প্রকৃত মালিককে দখল সত্ব বুঝিয়ে দেন।
এদিকে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আদালতের রায় উপেক্ষা করে ওই জমিতে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন ওই বিএনপি নেত্রী।
তৌহিদা খাতুন রোববার ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবে লিখিত এক অভিযোগে জানান, বিএনপি করার কারণে সাবেক কমিশনার আঞ্জু শক্তি প্রয়োগ করে জমি দখল করে ঘর নির্মান অব্যাহত রেখেছেন। তিনি কোন আইন কানুনের তোয়াক্কা করছেন না। আমি এবং আমার পরিবার পেশি শক্তির কাছে অসহায়।
জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা মহিলাদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর ফারহানা রেজা আনজু বলেন, এটা তার পৈতৃক সম্পত্তি। আদালতকে প্রভাবিত করে তারা তঞ্চকতার মাধ্যমে রায় নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আমরা ন্যায় বিচার পায়নি।
ঝিনাইদহ সদর থানার উপ-পরিদর্শক শাহাদাৎ হোসেন জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। পুলিশ উভয়পক্ষকে আদালতের রায় মেনে চলতে বলে এসেছে। এদিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্মানকাজ বন্ধ করে দিয়ে এলেও পরক্ষনে তা আবার শুরু করেছেন বলে তৌহিদা খাতুনের ছেলে এ্যাড. মাজহার সবুজ অভিযোগ করেন।
ঝিনাইদহ শহরে এই জমি দখলের ঘটনা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। অনেকেই এই ঘটনার প্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। পুলিশের ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও তা পুনরায় শুরু হওয়া এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করছেন যে, প্রশাসনের দুর্বল ভূমিকা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এই ধরনের জমি দখল এবং আইনের অপব্যবহার হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে তারা একদিকে আদালতের রায় কার্যকর করতে চাচ্ছে এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই ধরনের পরিস্থিতি স্থানীয় আইনের শাসন এবং সামাজিক নিরাপত্তা উভয়ের জন্যই হুমকি স্বরূপ।
এই জমি বিরোধের মীমাংসার জন্য আদালতের রায়ের পূর্ণ কার্যকারিতা নিশ্চিত করা এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপের কার্যকরতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। প্রশাসনকে আইন অনুযায়ী কাজ করতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থেকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে।
একই সঙ্গে, জমির মূল মালিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জমির দখল ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। জমি নিয়ে বিরোধের এমন ঘটনা সমাজের অন্যান্য জায়গায়ও ঘটে থাকে এবং সঠিক সময়ে মীমাংসা না হলে তা দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক ও আইনি সমস্যা তৈরি করতে পারে।
যৌথ বাহিনীর পরিচয়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি সোনা লুট, মামলা
ঝিনাইদহের এই জমি দখলের ঘটনাটি শুধু একটি নির্দিষ্ট জমির বিরোধ নয়, বরং এটি দেশের বৃহত্তর সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি প্রতিফলন। আদালতের রায় এবং পুলিশী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা জমি দখলের মতো ঘটনা শুধু ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করছে না, বরং আইন ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এই সংকটের সমাধান কেবল আদালতের রায়কে কার্যকর করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক এবং প্রশাসনিক সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।