ঝিনাইদহের ক্রীড়াঙ্গন ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে, যেখানে সাত বছর ধরে কোন ধরণের খেলাধুলার আয়োজন করা হয়নি। জেলার প্রধান খেলার মাঠ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্টেডিয়াম এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। একসময় যেখানে খেলোয়াড়রা নিয়মিত প্র্যাকটিস এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতো, সেখানে এখন হাঁসের দল পানি জমে থাকা মাঠে জলকেলি করে। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল সব ধরনের খেলাই দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ, আর এই অবস্থা চলতে থাকলে ঝিনাইদহের ক্রীড়া সংস্কৃতি পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারে।
খুলনা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কমিটিতে ঝিনাইদাহের সিনিয়র সাংবাদিক আসিফ কাজল
ঝিনাইদহের এই বিপর্যয়ের মূল কারণ হিসাবে স্থানীয় রাজনীতির বিরোধ এবং ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচন না হওয়ার জটিলতাকে দায়ী করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের জটিলতায় ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচন দীর্ঘদিন স্থগিত রয়েছে। নির্বাচনের অভাবে পেশাদার খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় ক্রীড়া সংস্থার নেতৃত্ব চলে গেছে আমলাদের হাতে, যা ক্রীড়াঙ্গনে হতাশা ও অচলাবস্থা তৈরি করেছে।
২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্রীড়া সংস্থার আয়ের হিসাব থেকে দেখা যায়, সংস্থাটি বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে মোট ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা জমা করেছে, যার মধ্যে ১ কোটি ৫৮ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তবে এই অর্থের সঠিক হিসাব এবং কোন খাতে এই ব্যয় হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে সোনালী ব্যাংকের একাউন্ট থেকে ৬ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে, যা নিয়ে কোনো স্বচ্ছ ব্যয়ের হিসাব নেই। অভ্যন্তরীণ অডিট না হওয়ায় দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে, যা ক্রীড়া সংস্থার কার্যক্রমে আরও অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে।
ক্রীড়াঙ্গনের এই করুণ পরিস্থিতিতে জেলার সাবেক ফুটবলার এবং বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক আহসান উদ্দীন আফাঙ্গীর ক্রীড়া সংস্থার নেতৃত্ব পেশাদার খেলোয়াড়দের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, পেশাদার খেলোয়াড়দের নেতৃত্ব ছাড়া মাঠে প্রাণবন্ত পরিবেশ ফিরে আসবে না। এছাড়া দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করে ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচন দাবি করেছেন, যা নতুন নেতৃত্ব এনে মাঠে খেলাধুলার পরিবেশ পুনরুদ্ধারে সহায়ক হতে পারে।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাজিয়া আক্তার চৌধুরী বলেন, ক্রীড়া সংস্থার নতুন কমিটি গঠন হলেই কেবল ক্রীড়াঙ্গনে প্রাণ ফিরতে পারে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এবং বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর ফুটবল, ভলিবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজনের আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, সঠিক নেতৃত্ব এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ঝিনাইদহের ক্রীড়াঙ্গনে আবারো জাগরণ আনা সম্ভব।
ঝিনাইদহের ক্রীড়া সংস্থার নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণে জেলার ক্রীড়াঙ্গন ধ্বংসের মুখে পড়েছে। স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে, ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচন এবং কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিতর্কের শিকার হয়েছে। ২০১৭ সালের যুবলীগ নেতা রাশিদুর রহমান রাসেল এবং আওয়ামী লীগ নেতা জীবন কুমার বিশ্বাসের মধ্যে দ্বন্দ্বই এই জটিলতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচনের স্থগিত এবং আদালতে মামলার সূত্রপাত ঘটায়।
ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচনে এই জটিলতা এবং পেশাদার নেতৃত্বের অভাবের কারণে ঝিনাইদহের ক্রীড়াঙ্গন প্রাকটিসের অভাব, প্রতিযোগিতার বন্ধ হওয়া, এবং তরুণ খেলোয়াড়দের বিকাশের সুযোগ না পাওয়ার মতো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। পেশাদার খেলোয়াড়দের সাথে নিয়মিত সংযোগ না থাকায় জেলার তরুণ প্রজন্ম খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে, এবং মাঠে তাদের উপস্থিতি ক্রমশ কমছে। পেশাদার খেলোয়াড়দের পরিবর্তে আমলাদের নেতৃত্বে গঠিত এডহক কমিটি সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ক্রিকেট বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া
ক্রীড়া সংস্থার অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষ করে সোনালী ব্যাংক থেকে ৬ লাখ টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে। দীর্ঘদিন কোনো অভ্যন্তরীণ অডিট না হওয়ায় দুর্নীতির অভিযোগও তুলেছেন অনেকে। যদিও সংস্থাটি অনেক টাকা আয় করেছে, তা সত্ত্বেও মাঠের উন্নয়ন বা ক্রীড়া কার্যক্রমে অর্থ বিনিয়োগ হয়নি। ফলে মাঠের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে এবং গ্যালারি, ড্রেসিং রুম, এবং অন্যান্য অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ছে।
এই অবস্থা ক্রীড়া সংস্থার নেতৃত্বের অদক্ষতা এবং দুর্নীতির স্পষ্ট প্রতিফলন। স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠকরা মনে করছেন, যদি পেশাদার নেতৃত্ব ফিরিয়ে আনা না হয় এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা না করা হয়, তবে ক্রীড়া খাতের উন্নতি সম্ভব হবে না।
ঝিনাইদহ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্টেডিয়ামের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। দীর্ঘদিন ধরে খেলাধুলা না হওয়ায় মাঠে পানি জমে আছে এবং সেখানে হাঁসের দল জলকেলি করছে। গ্যালারির কাঠামো এবং ড্রেসিং রুমের রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় এগুলো এখন ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে। মাঠে খেলা ফেরানোর জন্য স্টেডিয়ামের সংস্কার এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন। তবে এই কাজগুলোর জন্য ক্রীড়া সংস্থার থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এছাড়াও, স্টেডিয়ামটি এখন রাজনীতির বলি হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে কোনো উন্নয়নমূলক কাজ বা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। জেলা প্রশাসন যদিও মাঠ সংস্কারের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছে, তবে বাস্তবে তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে।
ঝিনাইদহে সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত
ঝিনাইদহের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে আগ্রহী ক্রীড়া সংগঠক ও খেলোয়াড়রা আশা করছেন, ক্রীড়া সংস্থার নেতৃত্বে পরিবর্তন এনে এবং রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে মাঠে খেলাধুলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হবে তা সময়ই বলে দেবে। তরুণ খেলোয়াড়দের বিকাশের জন্য পেশাদার খেলোয়াড়দের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাদের অংশগ্রহণ ফিরিয়ে আনা ক্রীড়াঙ্গনের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে।
সর্বোপরি, যদি এই সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান করা না হয়, তবে ঝিনাইদহের ক্রীড়া সংস্কৃতি আরও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। খেলাধুলার প্রতি মানুষের আগ্রহ হারিয়ে যাবে এবং তরুণ প্রজন্মও খেলাধুলা থেকে দূরে সরে যাবে। তবে সঠিক নেতৃত্ব এবং সঠিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, এবং ঝিনাইদহের ক্রীড়াঙ্গনে আবারো প্রাণ ফিরে আসবে।