ঝিনাইদহ প্রতিনিধি- ঝিনাইদহের শৈলকুপার দুধসর গ্রামে নিখোঁজের তিন দিন পর মাদ্রাসা ছাত্রী আইরিন আক্তার তিথির (১৭) মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় ওই গ্রামের একটি বাগান থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিথি রাবেয়া খাতুন মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন এবং তার পরিবার থেকে জানা গেছে, তিনি গত শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি ফোন কল পেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন।
শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছেন, নিখোঁজের পর থেকে পরিবারের সদস্যরা তাকে খুঁজতে থাকেন, তবে তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। রোববার সন্ধ্যায় বাড়ির পাশের একটি বাগানে স্থানীয় লোকজন তিথির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মৃতদেহটি উদ্ধার করে। ওসি সফিকুল ইসলাম আরও বলেন, মৃতদেহের গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় পাওয়া গেছে, যা দেখে প্রাথমিকভাবে এটি একটি হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার মুখও বিকৃত হয়ে গেছে, যা দেখে বোঝা যায় তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতে পারে।
হত্যা মামলা দায়েরের ঘটনায় সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি
নিহতের বাবা আশরাফ হোসেন অভিযোগ করেছেন, তার মেয়েকে কৌশলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “আমার মেয়ে কাউকে কোনো ক্ষতি করেনি। কেউ তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।”
এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে সচরাচর দেখা যায় না, তাই স্থানীয়ভাবে বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই ধারণা করছেন, এটি কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড হতে পারে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছু বলা হয়নি। তারা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
তিথির পরিবার জানায়, আইরিন আক্তার তিথি ছিলো পরিবারের একমাত্র মেয়ে। তার পড়াশোনা নিয়ে সে খুবই আগ্রহী ছিল। সম্প্রতি সে তার মাদ্রাসার পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছিল এবং উচ্চশিক্ষার জন্য পরিবারের কাছে পরিকল্পনা জানিয়েছিল। তিথির মা-বাবা জানান, তাদের মেয়ে সব সময় শান্ত স্বভাবের ছিল এবং পরিবারের প্রতি খুব যত্নশীল ছিল।
ঝিনাইদহে শিক্ষার মান ও কলেজ ক্যাম্পাসের পরিবেশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলন
এ ঘটনা শৈলকুপার দুধসর গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। গ্রামবাসীর অনেকে ধারণা করছে, অপরাধী হয়তো স্থানীয় কেউ হতে পারে, কারণ তিথি গ্রাম ছাড়েনি এবং তার মৃতদেহ গ্রামসংলগ্ন বাগানেই পাওয়া গেছে। গ্রামবাসী এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছে এবং অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে মৃতদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত করা যাবে। পুলিশ এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি, তবে তারা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নজরদারিতে রেখেছে এবং তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে।
ওসি সফিকুল ইসলাম জানান, “আমরা এখনও নিশ্চিত নই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কী কারণ রয়েছে। তবে প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আমরা এই ঘটনাকে খুব গুরুত্ব সহকারে দেখছি এবং দ্রুত অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।”
ময়নাতদন্তের রিপোর্টে স্পষ্ট হবে, তিথির শরীরে অন্য কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল কিনা বা তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল কিনা। এ ঘটনার পর তার পরিবার একটি মামলা দায়ের করেছে এবং তারা তাদের মেয়ের হত্যার বিচার চায়। মামলায় তাদের অভিযোগ, তিথিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং তাকে হত্যার আগে সম্ভবত তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন সময়ে এমন ঘটনাগুলো সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে, যা সমাজের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইরিন আক্তার তিথির এই নির্মম হত্যাকাণ্ড সেই বিষয়টিকেই নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই ধরনের ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিথির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাবেয়া খাতুন মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, তিথি ছিলো একজন মেধাবী ও শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। তার শিক্ষকরা বলেন, “তিথির এভাবে চলে যাওয়া আমাদের জন্য এক বড় ক্ষতি। আমরা কখনো ভাবতেও পারিনি যে আমাদের প্রিয় ছাত্রীকে এভাবে হারাতে হবে। আমরা তার হত্যার দ্রুত বিচার চাই।” বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তিথির স্মরণে একটি শোকসভা আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে তার সহপাঠী এবং শিক্ষকরা উপস্থিত থাকবেন।
এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে সমাজে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয়ভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানো দরকার। এছাড়া, স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। আত্মরক্ষা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই স্বপ্নগুলো কবর হয়ে গেল রবিউলের মৃত্যুর সঙ্গে।
পাশাপাশি, অভিভাবকদেরও সন্তানদের প্রতি সচেতন থাকতে হবে এবং কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে, মেয়েদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন, যাতে তারা যেকোনো ধরনের বিপদের মুখোমুখি হলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।
আইরিন আক্তার তিথির এই নির্মম হত্যাকাণ্ড স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। গ্রামবাসী, তিথির পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তার হত্যার সঠিক বিচার চায়।
তবে এই ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি সমাজে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের আরো একটি উদাহরণ। আইনের প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা এবং পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব।