ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে উভয় দেশই উপকৃত হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। নেতৃত্বের পরিবর্তন যাই হোক না কেন, এই প্রকল্পগুলো চলমান থাকবে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে, এবং এই সম্পর্ক দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
জয়শঙ্কর মঙ্গলবার ‘ইন্ডিয়া, এশিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন, যা এশিয়া সোসাইটি এবং এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউট আয়োজিত হয়েছিল। সেখানে তিনি বাংলাদেশের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, “গত এক দশকে আমরা যা করেছি, তা দুই দেশের জন্যই সুফল বয়ে এনেছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উভয় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। এতে আঞ্চলিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এসেছে।”
ট্রাম্প শোনেন কিন্তু মার্কিন অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব সম্পর্কে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীরব থাকেন
সম্প্রতি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে, কারণ হাসিনার সরকারের অধীনে দুই দেশের মধ্যে সুদীর্ঘ ও ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তবে এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও ভারতের অবস্থান দৃঢ়। জয়শঙ্কর স্পষ্ট করেছেন যে নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
সাম্প্রতিক বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। বৈঠকটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয়। জয়শঙ্কর বৈঠকের বিষয়ে টুইটারে (এক্স) বলেন, “সোমবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।” এ বৈঠককে দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, যৌথ নদীর পানি নিয়ে শিগগিরই আলোচনা শুরু হবে, যা দুই দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এছাড়া, ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) এর মতো প্রতিষ্ঠিত প্রক্রিয়াগুলো সক্রিয় করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এফওসি হলো দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি।
ট্রাম্প ও ভ্যান্স বনাম হ্যারিস ও ওয়ালজ: মিডিয়া সাক্ষাৎকারের দৌড়
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিন্ন নদীগুলোর পানি ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘদিনের আলোচনা রয়েছে, বিশেষ করে তিস্তা নদীর জলবণ্টন চুক্তি। বাংলাদেশের সরকার তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য অংশ দাবি করছে, যা দেশের কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিস্তা নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে কিছু জটিলতা থাকলেও, দু’দেশের সম্পর্কের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে এই ইস্যুতে ইতিবাচক সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
তিস্তার পানি নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরুর প্রক্রিয়াটি দু’দেশের সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নতুন সরকার এই ইস্যুটিকে অগ্রাধিকার দিতে পারে। ভারতও এই অঞ্চলে তার প্রভাব ধরে রাখতে আগ্রহী, বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক যাতে শক্তিশালী থাকে তা নিশ্চিত করতে চায়।
ট্রাম্প শোনেন কিন্তু মার্কিন অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব সম্পর্কে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীরব থাকেন
ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প রয়েছে, যা মূলত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য বৃদ্ধি, এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই প্রকল্পগুলো শুধু দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াচ্ছে না, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ ধরনের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- বাংলাদেশ-ভারত বিদ্যুৎ বিনিময় চুক্তি: ভারত বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এবং এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ সহযোগিতা বেড়েছে।
- যোগাযোগ ও পরিবহন: উভয় দেশই যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে। রেল ও সড়কপথে যোগাযোগের উন্নতির মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সংযোগ বাড়ছে, যা আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে।
- বাণিজ্য ও বিনিয়োগ: ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় দেশই একে অপরের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
জয়শঙ্করের বক্তব্যে বাংলাদেশের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সময় ভারত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার সাথে ভারতের ইতিবাচক সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দেশটির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে।
গ্রীক দ্বীপে অভিবাসী জাহাজ ডুবিতে অন্তত চারজনের মৃত্যু
তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিবেশীদের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় ইতিবাচক ও গঠনমূলক। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জগুলোতে আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি, যেমনটি আমরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও করেছি। আমাদের লক্ষ্য হলো এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।”
৫ আগস্ট, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। নতুন নেতৃত্বের আগমনের ফলে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে তা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল এবং অনেক দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পও গৃহীত হয়েছিল। তবে নতুন সরকার আসার পর এই সম্পর্ক কেমন থাকবে তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলোর ওপর পড়বে না।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অন্যতম প্রধান অংশীদার এবং ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত চীনসহ অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির প্রভাব মোকাবিলা করতে বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত রেখে ভারত তার কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চায়।
শ্রীলঙ্কার চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ?
চীন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যা ভারতকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করেছে। তবে ভারত তার প্রভাব ধরে রাখতে এবং বাংলাদেশকে আরও সমর্থন দিতে কৌশলগত পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশেষ করে, বাণিজ্য, নিরাপত্তা, এবং অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা বাড়িয়ে ভারত তার অবস্থানকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে, এবং দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলো উভয়ের জন্যই সুফল বয়ে এনেছে। নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও এই সম্পর্ক এবং প্রকল্পগুলো অটুট থাকবে বলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আশ্বস্ত করেছেন। বিশেষ করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য উভয় দেশেরই এই সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে এই সম্পর্ক আরও কীভাবে এগিয়ে যাবে তা সময়ই বলে দেবে, তবে এখন পর্যন্ত উভয় দেশই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোচ্ছে।
ভিওএ সুত্র থেকে নেওয়া