বাংলাদেশের ওষুধ খাত দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৮২ সালে ঔষধ নীতি প্রবর্তনের পর থেকে এই খাত দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে। বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ ওষুধের চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশই দেশীয় উৎপাদন থেকে মেটানো হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, রপ্তানি খাতেও ওষুধ শিল্পের অবদান ক্রমেই বাড়ছে। গত অর্থবছরে দেশের ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৮ কোটি ডলারেরও বেশি। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে পারলে এই খাতের রপ্তানির পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ওষুধ শিল্পের জন্য অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এবং নিয়ন্ত্রিত। এই বাজারে প্রবেশ করতে হলে কেবল গুণগত মানের পণ্য উৎপাদনই নয়, বরং উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়া, মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন নিয়ম-নীতির প্রতিপালন পর্যবেক্ষণ করে অনুমোদন দিয়ে থাকে। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএর পরিদর্শক দলগুলোর আগমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে, অনেক কোম্পানি বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করে বসে থাকলেও, তাদের আবেদনগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে আছে।
ঢাকার মেট্রোরেল ভাড়ার তুলনামূলক বিশ্লেষণ: আঞ্চলিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট
আবদুল মোক্তাদির, ওষুধশিল্প মালিক সমিতির সভাপতি এবং ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এই পরিস্থিতি নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনে করেন, নতুন সরকার যদি এফডিএ প্রতিনিধিদের নিরাপদে বাংলাদেশে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে পারে, তবে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ বাজারে প্রবেশ করতে পারলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের রপ্তানি বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধ মূলত ভারত, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের আকার এবং মানদণ্ডের কারণে, সেখানে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি একটি বিশাল সাফল্য হতে পারে।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে কৃষকদের মাঝে মাসকলাই ও পেঁয়াজ বীজ বিতরণ
এফডিএ থেকে অনুমোদন পাওয়া ওষুধ কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বাজারে বিশেষ সুবিধা পাবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট অ্যাক্ট (টিএএ) এর আওতায় সরকারি পর্যায়ে বিশেষ সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে রপ্তানি করতে হলে এফডিএর অনুমোদন অপরিহার্য। এ কারণে, এফডিএর প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হলে, দেশের ওষুধ শিল্পের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং গ্যাস সংকট। বিশেষ করে, গ্যাসের অভাবে অনেক কোম্পানি ডিজেল ব্যবহার করে বয়লার চালাতে বাধ্য হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি নির্ভর কাঁচামালের দামও বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে, অনেক ছোট ও মাঝারি ওষুধ কোম্পানি লোকসান গুনছে।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ডলারের বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের দামও কিছুটা কমেছে। আবদুল মোক্তাদির আশা করছেন, ডলারের দাম যদি ১১০ টাকার মধ্যে নামিয়ে আনা যায়, তাহলে ওষুধ কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচও কমে আসবে এবং তাদের লোকসান পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে, দেশের ব্যাংক খাতের সমস্যাও শিল্প খাতের বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নতুন বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে, যার ফলে কর্মসংস্থানেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ওষুধ শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসছে না বললেই চলে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগবান্ধব নীতি এবং ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
ঢাকা মহানগরীর বাজারসমূহের পাইকারী ও খুচরা বাজারদর
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের অন্যতম প্রধান সম্ভাবনা হলো জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন। বাংলাদেশে ওষুধ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে যদি জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও জেনেরিক ওষুধ রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এছাড়া, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও জেনেরিক ওষুধের চাহিদা রয়েছে। তবে, এজন্য কাঁচামাল উৎপাদনে প্রণোদনা এবং স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুরক্ষানীতির প্রয়োজন।
ওষুধ শিল্পের রপ্তানি বাজারের বৈচিত্র্যতা নিয়ে কাজ করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে ১৪০টিরও বেশি দেশে। তবে, প্রধান রপ্তানি বাজার হিসেবে ভারত, ভুটান, নেপাল এবং মিয়ানমারের মতো দেশগুলোতে রপ্তানিই বেশি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় এবং সুরক্ষিত বাজারে প্রবেশ করতে পারলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বৈশ্বিক অবস্থানও শক্তিশালী হবে।
একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ওষুধের মেধাস্বত্ব আইন। বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকায় ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্ব আইন থেকে ছাড় পাচ্ছে। কিন্তু এরপর যদি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় চলে আসে, তাহলে মেধাস্বত্ব আইন মেনে উৎপাদন করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে, সরকার এবং শিল্পমালিকদের যৌথভাবে একটি কৌশল প্রণয়ন করতে হবে, যাতে মেধাস্বত্ব আইনের বাধ্যবাধকতা পূরণ করেও দেশের ওষুধ শিল্পের উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।
ওষুধ শিল্পে বর্তমানে শ্রম বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দেশব্যাপী শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবি উঠেছে। ওষুধ শিল্পে শ্রমিকদের মধ্যে ন্যায্য মজুরির দাবি নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ ছিল। তবে, অধিকাংশ কোম্পানি শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়ে এই অস্থিরতা দ্রুত সমাধান করতে পেরেছে। আবদুল মোক্তাদির উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে অধিকাংশ কোম্পানি শ্রমিকদের সরকার নির্ধারিত মজুরির চেয়েও বেশি প্রদান করে।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে একটি স্থিতিশীল এবং টেকসই খাতে রূপান্তরিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে নীতিগত সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, ডলার সংকট, গ্যাস সংকট এবং কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক সুবিধার মতো বিষয়ে সরকারের সরাসরি উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া, নতুন প্রযুক্তি এবং গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএন্ডডি) খাতে বিনিয়োগের জন্য শিল্পমালিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
দাম কমল জ্বালানি তেলের, আজ রাত ১২টা থেকে কার্যকর
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে যে পরিমাণ সম্ভাবনা রয়েছে, তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলে এ খাত দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তিতে পরিণত হতে পারে। তবে, এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পবান্ধব নীতি, নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য কার্যকর কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।
ওষুধ শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবৃদ্ধি তেমন না থাকলেও, আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে পারলে এই খাতের জন্য বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হবে। তবে, এ জন্য ডলার সংকট, গ্যাস সংকট, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণের মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তাদের কৌশলী পদ