বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। এই আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার এবং সামাজিক বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ জনগণের প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। তবে, এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে এ ধরনের আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ধরনেরই এক মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হয়েছে বগুড়ার শিশু শিক্ষার্থী জুনায়েদ ইসলাম রাতুল।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে ৪৮ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেছে সে। আজ আমরা এই ঘটনার পেছনের প্রেক্ষাপট, পরিবারের শোকাবহ পরিস্থিতি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশদ আলোচনা করব।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটি মূলত শুরু হয়েছিলো দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, দেশের প্রতিটি শিশু যেন সমান সুযোগ পায়, তাদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত হয় এবং কোনও বৈষম্য না থাকে। এই আন্দোলনে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক এবং সাধারণ জনগণ একাত্ম হয়।
বগুড়ায় এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীরা। তারা জনগণের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ এবং পদযাত্রা আয়োজন করেন। শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষরা এতে অংশগ্রহণ করে তাদের সমর্থন জানায়। বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে এই আন্দোলনটি নতুন করে সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কারণ, শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিশুদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে আরও গুরুত্ব দেয়।
ঝিনাইদহে ৮ হত্যা মামলায় পুলিশের ৪৩ কর্মকর্তা আসামী
রাতুলের বড় বোন জেরিন ও তার ভগ্নিপতি আমির হামজা এই আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন। তারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করতেন এবং তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানাতেন। তাদের এই কর্মকাণ্ড দেখে রাতুলও আন্দোলনে যোগ দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও, ৫ আগস্ট বিকেলে রাতুল তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয়।
রাতুলের বড় বোন জেরিন জানায়, সে রাতে তাদের পাশে ছিল। স্লোগান দিতে দিতে তারা বগুড়া সদর থানার কাছাকাছি বড়গোলার কাছে পৌঁছে যায়। তখন হঠাৎ করে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।
ঝিনাইদহে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কৃষকের মৃত্যু
পুলিশের ছোড়া চারটি রাবার বুলেট এসে রাতুলের গায়ে লাগে, যার মধ্যে একটি তার মাথায় আঘাত করে। গুলিটি তার বাম চোখের মাধ্যমে মাথার মগজে প্রবেশ করে এবং মস্তিষ্কের গভীরে গিয়ে আটকে যায়। এরপর, আরও অর্ধশতাধিক রাবার বুলেট তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। রাতুল মাটিতে পড়ে যায় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়।
অবিলম্বে তাকে বগুড়ার শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা জানায়, রাতুলের অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন এবং তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। রাতুলকে দ্রুতই ঢাকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসাইন্স হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে সে ৪৮ দিন ধরে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিল।
রাতুলকে যখন ঢাকায় নিয়ে আসা হয়, তখন তার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন ছিল। মাথার ভেতরে আটকে থাকা গুলিটি বের করার জন্য জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয়। এই অস্ত্রোপচারের পর তার অবস্থা সামান্য উন্নতি হয়, কিন্তু সে এখনও কোমায় ছিল। হাসপাতালের চিকিৎসকরা চেষ্টা করছিলেন তার অবস্থা স্থিতিশীল রাখতে, কিন্তু রাতুলের শরীর নানা জটিলতায় ভুগছিল।
ঝিনাইদহে ট্রাক চাপায় এক যুবকের মৃত্যু
রাতুলের মা রোকেয়া বেগম এবং বাবা জিয়াউর রহমান হাসপাতালের বিছানার পাশে বসে দিনরাত প্রার্থনা করছিলেন। রোকেয়া বেগম জানান, “আমি ভাবতাম, এই বুঝি আমার ছেলে ‘মা’ বলে ডাকবে। কিন্তু আমার অপেক্ষা আর শেষ হলো না। ৪৮ দিনেও রাতুল চোখ মেলে তাকায়নি। সে আর কখনো মাকে ডাকবে না।”
রাতুলের মৃত্যুর খবর বগুড়ায় পৌঁছানোর পর, পুরো উপশহরে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার সহপাঠী, শিক্ষক, প্রতিবেশী এবং স্থানীয় বাসিন্দারা সবাই শোক প্রকাশ করে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে রাতুলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। তারা স্কুলের মাঠে এক মিনিট নীরবতা পালন করে এবং পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। স্কুল কর্তৃপক্ষও এই মর্মান্তিক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
রাতুলের বাবা, মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এই শোক সহ্য করতে পারছিলেন না। মুদির দোকানী বাবা জিয়াউর রহমান জানান, “আমার সর্বস্ব বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করেছি। তবুও সন্তানকে ফিরে পেলাম না। আমাদের আর কোনও স্বপ্ন নেই, আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।”
রাতুলের মৃত্যুর খবর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার পর, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানবাধিকার সংগঠন এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো পুলিশের এই ধরনের আচরণের তীব্র নিন্দা জানায় এবং ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করে।
শিক্ষার্থীদের সংগঠনগুলো রাতুলের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এবং তার স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। তারা জানায়, রাতুলের মৃত্যু কোনোভাবেই ন্যায়সংগত ছিল না। শিশুদের আন্দোলনে অংশগ্রহণকে দমনের জন্য পুলিশের এমন সহিংসতা অমানবিক এবং গ্রহণযোগ্য নয়।
এমন একটি আন্দোলনে, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার ও সমান সুযোগের জন্য দাবি তোলা হয়, সেখানে পুলিশের গুলিবর্ষণ ও শিশুদের ওপর নির্যাতন কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মানবাধিকার সংস্থা এবং বিভিন্ন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সরকারের নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাত এক বৃদ্ধর মৃত্যু
প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ঘটনার বিষয়ে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় পুলিশ এই ঘটনার জন্য আন্দোলনকারীদের দায়ী করে বলেছে, তারা যদি শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করত, তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না। পুলিশের দাবি অনুযায়ী, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে।
এদিকে, স্থানীয় জনগণ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো পুলিশের এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয়। তারা মনে করেন, আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান সত্ত্বেও, পুলিশ অহেতুক গুলিবর্ষণ করেছে এবং এতে একটি শিশুর প্রাণহানি হয়েছে।
রাতুলের মৃত্যুর পর তার পরিবার এবং স্থানীয় জনগণ একটি নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। তারা আশা করছেন, সরকার ও প্রশাসন এই ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবে। এছাড়া, শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে তারা আশা করছেন।
আশীর্বাদের ৪ দিন পর অন্ত কুন্ডুর মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াসা, পরিবারটিতে চলছে শোকের মাতম
রাতুলের মৃত্যুতে সামাজিক আন্দোলনগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণ তাদের সমর্থন জানাতে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। তারা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে, শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রাতুলের মৃত্যু আমাদের সমাজের এক ভয়াবহ বাস্তবতা উন্মোচিত করেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য একটি শিশু তার জীবন হারিয়েছে। তার এই করুণ মৃত্যুর ঘটনাটি আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। আমরা যদি এমন একটি সমাজ গঠন করতে চাই যেখানে শিশুরা নিরাপদে বড় হতে পারে, তাহলে আমাদের উচিত তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের অধিকার রক্ষা করা এবং সামাজিক বৈষম্য দূর করা।
সকলের প্রতি এই আহ্বান, আসুন আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করি, যেন আর কোনও শিশু রাতুলের মতো করুণ পরিণতির শিকার না হয়। আসুন, আমরা একটি ন্যায়পরায়ণ ও সমতা ভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হই, যেখানে প্রতিটি শিশুর জীবন ও অধিকার