ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় সংখ্যালঘু পরিবারের ফসলী জমি দখল করে ফুটবল খেলার মাঠ বানানোর অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে, জমিতে থাকা কাঁচা ধান লুটের পাশাপাশি ধ্বংস করা হয়েছে রোপা আমনক্ষেত এবং আবাদ করা মাসকলাই। জমির মালিকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার পাশাপাশি তাদের জীবননাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জমি ফেরত ও জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে ভুক্তভোগীরা সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করেছেন।
ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা ভরত দাস ও তার পরিবার দীর্ঘদিন ধরে হামিদপুর মৌজার ২৮৬১ আর এস খতিয়ানের ৪০৩৯ ও ৪০৪০ দাগের মোট ২০৭ শতক জমিতে চাষাবাদ করে আসছেন। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এই জমি তাদের সংসারের প্রধান উপার্জন। কিন্তু সম্প্রতি এই জমি দখল করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা একটি ফুটবল খেলার মাঠ তৈরি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, গত ৫ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মহেশপুর পৌরসভার কাউন্সিলর বাবুল হোসেন তার সহযোগীদের নিয়ে এই জমি দখল করে।
মহেশপুর সীমান্ত থেকে ৩ রোহিঙ্গাসহ ১০ জন আটক
জমিতে থাকা কাঁচা ধান লুট করার পাশাপাশি কিছুদিন আগে রোপন করা আমনক্ষেত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবার। ট্রাক্টর দিয়ে চষে ফেলা হয়েছে আবাদ করা মাসকলাই ক্ষেতও। জমির মালিক ভরত দাসের ছেলের বৌ রেখা দাস বলেন, “জোর করে আমাদের জমির ধান পুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা ধান চাষ করে আমাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে চলতাম। এখন ধান চাষ করতে না পারলে আমরা কীভাবে চলব? জমি দখলকারী স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিচারের দাবি জানাচ্ছি প্রশাসনের কাছে।”
ভরত দাসের ছেলে পরিমল দাস অভিযোগ করে বলেন, “আমরা সংখ্যালঘু, তাই আমাদের জমি দখল করে নিয়েছে। জমিতে গেলে আমাদের ওপর হামলা চালানো হয়। গাছপালা কেটে সবকিছু দখল করে নিয়েছে।” মহেশপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল কাদের বলেন, “এখানে কোনোদিন খেলার মাঠ ছিল না। ভরত ও শম্ভু দাস তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি শত বছর ধরে ভোগ করে আসছে। জমি দখলের প্রতিবাদ জানিয়ে তারা প্রায়ই ভয়ভীতি ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন।”
ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় ৩ রোহিঙ্গা নারীসহ মোট ১৭ জনকে আটক
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রামবাসী বলেন, “বিরোধীরা হুমকি দিয়ে জমি দখল করেছে। বর্তমানে যাদের দখলে জমি রয়েছে, তারা বলছে যে জমির রেকর্ড তাদের নামে রয়েছে। তবে, জমি দখলের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।” স্থানীয়রা বলছেন, “যারা দখল করেছে তারা অবৈধভাবে দখল করেছে। এখানে আগে কোনো খেলার মাঠ ছিল না এবং কেউ কখনও খেলতেও দেখিনি।”
অভিযুক্ত মহেশপুর পৌরসভার কাউন্সিলর বাবুল হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “সংখ্যালঘু পরিবারের ফসলী জমি আমি দখল করেছি কে বলেছে! এটা প্রমাণ করতে হবে। আমি জমি দখলের বিষয়ে কিছু জানি না।” যদিও কাউন্সিলর বাবুল হোসেন জমি দখলের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, তবে তিনি এবং তার সহযোগীরা জমিতে গিয়ে খেলার মাঠ দাবি করে পাল্টা মানববন্ধন করেছেন।
মহেশপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শরীফ শাওন বলেন, “জমিটি ভিপি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত। তবে, বর্তমানে ভরত ও তার ভাই শম্ভু দাসের নামে রেকর্ড থাকায় তারা জমির মালিক এবং তারা ভোগদখল করতে পারবেন।” মহেশপুর থানার ওসি মাহব্বুর রহমান জানান, “এই ঘটনায় মহেশপুর থানায় চারজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মহেশপুর পৌরসভার ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি তবিবর রহমান এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বাবুল হোসেনসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।”
ঝিনাইদহে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালকদের সংবাদ সম্মেলন
জমি ফেরতের দাবিতে এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভুক্তভোগী পরিবার সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। ভুক্তভোগী শম্ভু দাস বলেন, “আমাদের বাপ-দাদার জমি আমরা চাষ করি। আমরা সংখ্যালঘু, তাই আমাদের জমি দখল করা হয়েছে। আমরা বাধা দিয়েছি, কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনছে না। আমাদের জমিতে জোর করে খেলার মাঠ বানানো হয়েছে।”
বিরোধী পক্ষ বলছে, জমির রেকর্ড তাদের নামে রয়েছে এবং তারা বৈধ মালিক। স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে জমির প্রকৃত মালিকানা ও দখল নিয়ে তদন্ত চলছে। মহেশপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শরীফ শাওন বলেন, “জমিটি ভিপি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হলেও বর্তমানে ভরত ও তার ভাইয়ের নামে রেকর্ড রয়েছে। তাই তারা জমির বৈধ মালিক।”
মহেশপুর থানার ওসি মাহব্বুর রহমান জানান, “জমি দখল ও ফসলহানির ঘটনায় মহেশপুর থানায় মামলা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করতে আমরা তৎপর রয়েছি।” ভুক্তভোগী পরিবার আইনের আশ্রয় নিয়েছে এবং তারা আশা করছে যে প্রশাসন সঠিক বিচার করবে। তারা আরও জানিয়েছে, “আমাদের আয়ের একমাত্র উৎস এই জমি। আমরা ফসল করে আমাদের পরিবার চালাই। এই জমি যদি আমাদের ফেরত না পাওয়া যায়, তাহলে আমরা পথে বসব।”
ঝিনাইদহের রাজস্ব খাত থেকে বেতন ভাতা প্রদানের দাবীতে ইউনিয়ন ডিজিটাল
এ ধরনের জমি দখল ও ফসলহানির ঘটনা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগজনক। সংখ্যালঘুদের ভূমি ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের আরো সচেতন হওয়া উচিত। সম্প্রতি বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘুদের জমি দখল, মন্দিরে হামলা এবং অন্যান্য নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। এর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সম্পত্তি রক্ষা করা। প্রশাসনকে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে সংখ্যালঘুদের জমি ও সম্পত্তি সুরক্ষিত থাকে এবং তারা তাদের অধিকার নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে।
সরকারকে এ ধরনের ঘটনাগুলোর প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। জমি দখল, ফসলহানি ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগে এই ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব। সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিরও প্রয়োজন।
ঝিনাইদহে ৮ হত্যা মামলায় পুলিশের ৪৩ কর্মকর্তা আসামী
ঝিনাইদহের মহেশপুরে সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখল ও ফসলহানির ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং উদ্বেগজনক। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের সামাজিক সম্প্রীতির উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণকে একসঙ্গে কাজ করে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।