বসির আহাম্মেদ, ঝিনাইদহ-: ঝিনাইদহে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা সংখ্যার ঊর্ধ্বগতির ফলে ঝিনাইদহে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই মামলাগুলোর প্রধান আসামী হিসেবে সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) আলতাফ হোসেনের নাম উঠে এসেছে, যিনি এরই মধ্যে চাকরীচ্যুত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড হওয়ার অভিযোগ উঠেছে এবং বিভিন্ন ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঝিনাইদহ শহর থেকে দিনেদুপুরে ইজিবাইক চুরি
এসপি আলতাফ হোসেনের সঙ্গে আরও ৪৩ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামী করা হয়েছে, যারা বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। এই তালিকায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপার, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই), সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর (এএসআই), কনস্টেবল ও ডিবি পুলিশের ওয়াচাররা রয়েছেন। অভিযোগে বলা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি একাধিক মামলায় আসামী হয়েছেন, যা পরিস্থিতির জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সদস্যরা বাদী হয়ে ঝিনাইদহের বিভিন্ন আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। যদিও এখনো পর্যন্ত কোন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। এ ছাড়াও পুলিশের পাশাপাশি ১৫৯ জন আ’লীগ নেতাকর্মীকেও এসব হত্যাকাণ্ডের মামলায় আসামী করা হয়েছে।
শৈলকুপায় সাড়ে ৮’শ কৃষকের মাঝে কীটনাশক বিতরণ
অন্যদিকে, ঝিনাইদহে জামায়াত নেতা আব্দুস সালাম হত্যা ও বিএনপি নেতাদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং দলীয় কার্যালয় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আ’লীগের ৮০৭ জন নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়েছে। এরমধ্যে ঝিনাইদহের সাবেক পাঁচজন সংসদ সদস্যও রয়েছেন।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ঝিনাইদহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আ’লীগের নেতাকর্মীরা মিলে সরকার বিরোধী আন্দোলন দমন করতে নানা ধরনের অভিযান পরিচালনা করেছে। বিশেষ করে, বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের সাংগঠনিক দক্ষতা রয়েছে এমন নেতাকর্মীদের টার্গেট করে এই অভিযান চালানো হয়। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে ৪০ জনকে সাদাপোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, যার মধ্যে ৩০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে কিছু সন্ত্রাসী ও চরমপন্থি দলের সদস্যও ছিল।
ঝিনাইদহে বিদ্যুৎ অফিসের লাইন সহকারীদের বেতন ভাতার দাবিতে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ
২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকার ৫৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবাজার মার্কেট কমিটির সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলামকে হত্যা করা হয়। সেদিন র্যাব পরিচয়ে তাকে শৈলকুপা উপজেলার আনন্দনগর গ্রামের ভাইরার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার আদাবাড়িয়া মনোহরপুর খালপাড়ে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের পরিবার এখনো কোনো মামলা করেনি।
এছাড়া ঝিনাইদহের বিভিন্ন উপজেলায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের হত্যার ঘটনায় ৮টি হত্যা ও ৩টি ভাংচুরের মামলা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু মামলা হলো:
- ২৭ আগস্ট জামায়াত কর্মী আব্দুস সালাম হত্যা মামলায় এক পুলিশ সদস্যসহ ৭০ জন আসামী।
- ২৯ আগস্ট যুবদল নেতা মিরাজুল ও শিবির নেতা ইবনুল পারভেজ হত্যা মামলায় ১১ পুলিশসহ ২৮ জন আসামী।
- ১ সেপ্টেম্বর জামায়াত নেতা ইদ্রিস আলী পান্না হত্যা মামলায় ৬ পুলিশসহ ২৯ জন আসামী।
- ১১ সেপ্টেম্বর শিবির নেতা সাইফুল ইসলাম মামুন হত্যা মামলায় ৯ পুলিশসহ ১৪ জন আসামী।
- ১৫ সেপ্টেম্বর জামায়াত নেতা এনামুল হত্যা মামলায় ৫ পুলিশসহ ১৯ জন আসামী।
- ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াত নেতা ও ইউপি সদস্য হাফেজ আবুল কালাম আজাদ হত্যা মামলায় ৩ পুলিশসহ ১৯ জন আসামী।
- ১৮ সেপ্টেম্বর শিবির নেতা আবুজার গিফারি ও শামিম হত্যা মামলায় ৮ পুলিশসহ ২৩ জন আসামী।
- ১৯ আগস্ট বিএনপি অফিস ভাংচুর মামলায় ৪৬৮ জন আ’লীগ নেতাকর্মী আসামী।
- ২৫ আগস্ট ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ মজিদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলায় ২৩৮ জন আসামী।
- বিএনপি নেতা আক্তারের দোকান ভাংচুর মামলায় ৩১ জন আসামী।
- ঝিনাইদহে শিবির কর্মী শামীম ও আবুজার গিফারী হত্যায় আদালতে মামলা পুলিশের ভূমিকা ও বিচার
মামলা নিয়ে পুলিশের কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে জেলার প্রধান আইন কর্মকর্তা (পিপি) এ্যাড. ইসমাইল হোসেন জানিয়েছেন, এসব ঘটনায় আগে অপমৃত্যুর মামলা হয়েছিল। এখন নতুন করে তদন্তে যদি পুলিশ কর্মকর্তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তবে তাদের আইনের আওতায় আনা হতে পারে।
এসব ঘটনা ঝিনাইদহে সন্ত্রাস দমনের নামে ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ উত্থাপন করেছে। পুলিশের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক কর্মীদের এই মেলবন্ধন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতিকে আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
ঝিনাইদহে দুই মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলিও এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে, যাতে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আর না ঘটে।