ঝিনাইদহ প্রতিনিধি—ঝিনাইদহে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (ওজোপাডিকো) লাইন সহকারীরা তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দাবিতে কর্মবিরতি দিয়ে বিক্ষোভ করেছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বিদ্যুৎ অফিস প্রাঙ্গণে তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন এবং বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিয়ে নিজেদের দাবি জানাতে থাকেন। এই আন্দোলনে লাইন সহকারী ইমামুল হক রকি, আব্দুল্লাহ আল মামুন, রুবেল হোসেন, মশিউর রহমান, আব্দুল মমিনসহ আরও অনেকেই বক্তব্য রাখেন এবং তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন।
হত্যা মামলা দায়েরের ঘটনায় সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি
লাইন সহকারীরা বছরের পর বছর ধরে ঝিনাইদহের বিদ্যুৎ অফিসে কাজ করছেন। তবে এতদিনেও তারা নিয়মিত বেতন-ভাতা পান না। তারা অভিযোগ করেন, অফিস টাইমের বাইরে অতিরিক্ত কাজ করলেও তাদের প্রাপ্য সম্মানী প্রদান করা হয় না। এমনকি বিভিন্ন দূর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে, যেমন ঝড়-বৃষ্টি বা অন্য কোনো বিপর্যয়ের সময় বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন করতে গিয়ে তারা জীবন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। তবুও তাদের এই কঠোর পরিশ্রমের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়, ফলে মৃত্যুবরণ বা অঙ্গহানির মতো ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়।
লাইন সহকারীদের দাবি, বিদ্যুৎ অফিসে কাজ শুরু করার পর থেকেই তারা নিয়মিত বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের অভিযোগ, অনেক বছর ধরে কর্তৃপক্ষের কাছে তারা তাদের বেতন-ভাতার দাবি জানিয়ে আসছেন, কিন্তু কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তাদের দাবি, কোনো বৈধ চুক্তি বা সরকারি নিয়ম-নীতি মেনে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর ফলে তারা বৈধভাবে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি পাননি এবং তাদের ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন।
ঝিনাইদহে শিক্ষার মান ও কলেজ ক্যাম্পাসের পরিবেশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলন
বক্তারা বলেন, “আমরা ঝড়-বৃষ্টি, রোদ-বৃষ্টিতে যখন তখন ডাক পেলেই কাজ করতে যাই। বিদ্যুৎ লাইন ঠিক রাখতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করি, অথচ আমরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাই না। অফিস টাইমের বাইরে কোথাও কাজ করতে গেলে নামমাত্র টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চালাতে হয়। এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরেও আমাদের জন্য কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই।”
লাইন সহকারীদের এই অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। লাইন সহকারীদের কাজ বন্ধ থাকায় কোনো সমস্যা হলে দ্রুত সমাধান করতে পারছে না বিদ্যুৎ অফিস। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের। বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলে যেখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা বেশি ঘটে, সেসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদ্যুৎ অফিসের অন্যান্য কর্মচারীদের।
বিদ্যুৎ অফিসের পক্ষ থেকে এখনও কোনো স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, “লাইন সহকারীদের এই দাবি নিয়ে আমরা শীঘ্রই কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় বসব। তারা আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের সমস্যার সমাধান করতে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”
লাইন সহকারীরা বিদ্যুৎ ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা মূলত বিদ্যুৎ লাইনের মেরামত, সংযোগ স্থাপন, এবং ত্রুটি সংশোধনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। বিশেষত, দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বা দুর্ঘটনার সময় তারা বিদ্যুৎ লাইন পুনঃস্থাপনের কাজ করেন। এতে তাদের জীবনের ঝুঁকি যেমন থাকে, তেমনি শারীরিক ও মানসিক চাপও অনেক বেশি।
তারা জানান, “কাজের সময় প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জামও অনেক সময় আমাদের দেওয়া হয় না। অথচ একটি ভুল সিদ্ধান্ত বা অপ্রস্তুত অবস্থায় কাজ করতে গিয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বিদ্যুৎ লাইনের কাজ করতে গিয়ে অনেকেই তাদের জীবন হারিয়েছেন, অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। এই কাজের বিপরীতে আমরা সামান্য যা পাই, তা দিয়ে আমাদের সংসার চালানো দায় হয়ে পড়ে।”
লাইন সহকারীদের মূল দাবি হচ্ছে:
- নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদান: তাদের কাজের ধরন ও ঝুঁকি বিবেচনা করে প্রাপ্য বেতন-ভাতা নিয়মিত প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
- চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ: তারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করলেও তাদের কোনো স্থায়ী চুক্তি বা নিয়োগপত্র নেই। এই বৈধ নিয়োগপত্রের ব্যবস্থা করতে হবে।
- বীমা সুবিধা: লাইন সহকারীদের জন্য জীবন বীমা, স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা করতে হবে।
- কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা: ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সময় প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ঝিনাইদহ জেলার বিদ্যুৎ গ্রাহকরা লাইন সহকারীদের আন্দোলনের প্রতি মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। একদিকে তারা লাইন সহকারীদের দাবির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে তাদের কর্মবিরতির কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেক গ্রাহক মনে করেন, লাইন সহকারীরা যদি তাদের সঠিক প্রাপ্যতা পেতেন, তাহলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই স্বপ্নগুলো কবর হয়ে গেল রবিউলের মৃত্যুর সঙ্গে।
একজন গ্রাহক বলেন, “তাদের আন্দোলনের কারণে আমাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, কিন্তু তাদের কথাও ঠিক। দীর্ঘদিন ধরে তারা যে বেতন-ভাতা পাচ্ছে না, এটা খুবই দুঃখজনক। সরকারকে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।”
বিদ্যুৎ বিভাগের লাইন সহকারীদের সমস্যার সমাধানে সরকার ও বিদ্যুৎ বিভাগকে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে:
- কর্মীদের সাথে আলোচনার উদ্যোগ: লাইন সহকারীদের দাবি ও সমস্যাগুলি বুঝে তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে।
- অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ীকরণ: যেসব লাইন সহকারী দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, তাদের বৈধ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
- বেতন কাঠামোর পুনর্বিবেচনা: লাইন সহকারীদের কাজের ধরন ও ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে তাদের বেতন কাঠামো পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
- সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবস্থা: কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঝিনাইদহের বিদ্যুৎ অফিসের লাইন সহকারীদের আন্দোলন একটি ন্যায্য অধিকার আদায়ের লড়াই। তাদের দাবি ও বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পেয়েছে। তবে, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় গ্রাহকদের সমস্যার কথাও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
মাকে বলেছিলেন, “আমরা দেশ বদলাতে যাচ্ছি মা, আমি আসব, তুমি চিন্তা করো না।” কিন্তু সেই আসা আর হলো না।
সরকার ও বিদ্যুৎ বিভাগের উচিত দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা, যাতে লাইন সহকারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পান এবং গ্রাহকরাও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা উপভোগ করতে পারেন।
এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে পারলে তা কেবল লাইন সহকারীদের জন্যই নয়, বরং বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এবং শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।