সাভারের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের মাঝে আজ মঙ্গলবার সকালে আবারো উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, যা পরিণত হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষে। এই সংঘর্ষে মোছা. রোকেয়া বেগম নামে এক নারী শ্রমিক নিহত হন এবং আহত হয়েছেন আরও অন্তত তিনজন। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো জানাচ্ছে, আহতের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন হতে পারে।
নিহত রোকেয়া বেগম মাসকট গার্মেন্টসের সহকারী সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০২1 সালের ১ ডিসেম্বর তিনি এই কারখানায় যোগ দেন। মাসকট গার্মেন্টসটি শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় বন্ধ ছিল, অর্থাৎ শ্রমিকদের আইনত ছাঁটাই বা ছুটিতে রাখা হয়েছিল। আজ সকালে বন্ধ কারখানার ফটকে মাসকটের শ্রমিকেরা জড়ো হন। একপর্যায়ে তারা পাশের সাউদার্ন এবং রেডিয়েন্স গার্মেন্টসের শ্রমিকদের ওপর হামলা করেন, যা পরবর্তীতে ত্রিমুখী সংঘর্ষের রূপ নেয়।
ঝিনাইদহে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নারীসহ ৩ জনের মৃত্যু
শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সংঘর্ষের সময় দুই পক্ষের শ্রমিকেরা একে অপরের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এই নিক্ষেপের সময় রোকেয়া বেগম ইটের আঘাতে নিহত হন। সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে দুজনকে আশুলিয়ার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, তবে আরও কয়েকজন শ্রমিক আহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। তারা জানিয়েছে, সংঘর্ষের সময় প্রচুর শ্রমিক জড়ো হয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছিলেন। পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবে সংঘর্ষের তীব্রতার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
শৈলকুপায় ট্রাকের ধাক্কায় মোটর সাইকেল চালক নিহত, আহত-১
মৃত রোকেয়া বেগমের লাশ স্থানীয় পিএমকে হাসপাতালে রয়েছে। সেখানে তাঁর মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা সাভারের বিভিন্ন হাসপাতালে চলছে। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হতে পারে।
সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক শিল্পাঞ্চলে গত দুই সপ্তাহ ধরে শ্রমিকদের মধ্যে অস্থিরতা চলছিল। শ্রমিকেরা তাদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, যা পরে শ্রমিক অসন্তোষে রূপ নেয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর শ্রমিকেরা তাদের বর্তমান মজুরি কাঠামো নিয়ে অসন্তুষ্ট।
গার্মেন্টস মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে, কিন্তু উত্তেজনা কমেনি। অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকেরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে কিছু কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত রোববার পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হলেও আজকের সংঘর্ষ আবারও পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেছে।
গত দুই সপ্তাহে বেশ কয়েকটি গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে আসেন এবং বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। যদিও সরকার ও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তবে সেই প্রতিশ্রুতিতে আস্থা না থাকায় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। ফলে বেশ কয়েকটি গার্মেন্টস বন্ধ করে দেওয়া হয়, যার মধ্যে মাসকট গার্মেন্টসও রয়েছে।
শ্রমিকদের অভিযোগ, মজুরি বৃদ্ধির দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়ার পরও অনেক কারখানা মালিক সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে শ্রমিকেরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় শ্রমিকেরা অভিযোগ করছেন যে, কারখানাগুলোতে কাজের চাপ বেড়ে গেলেও মজুরি বৃদ্ধির কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া বন্ধ কারখানার শ্রমিকেরা বেকার অবস্থায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শ্রমিকদের দাবি, অবিলম্বে মজুরি কাঠামো সংশোধন করে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশের এসপি মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেছেন, “সকাল পৌনে ১০টার দিকে মাসকট গার্মেন্টসের শ্রমিকদের সঙ্গে অন্য কারখানার শ্রমিকদের সংঘর্ষে এক শ্রমিক মারা গেছেন। তার লাশ পিএমকে হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এছাড়া দুজন আহত শ্রমিক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।”
তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন। শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং চেষ্টা করছেন যাতে করে ভবিষ্যতে এ ধরনের সংঘর্ষ আর না ঘটে। শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দাবিগুলো তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছে প্রশাসন।
গার্মেন্টস মালিক সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তারা শ্রমিকদের দাবিগুলোকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছেন। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মালিকপক্ষেরও কিছু দাবি রয়েছে, যার মধ্যে শ্রমিকদের আন্দোলন যেন সহিংস না হয়, তা নিশ্চিত করা অন্যতম।
আশুলিয়ার গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও একজন নারী শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা শ্রমিক অসন্তোষের নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এই ঘটনার পর শিল্পাঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রশাসন, মালিকপক্ষ এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোকে দ্রুত সমঝোতায় আসতে হবে, যাতে করে এ ধরনের সহিংস ঘটনা আর না ঘটে এবং শ্রমিকদের দাবিগুলো ন্যায়সংগতভাবে পূরণ করা যায়।