ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় গণপিটুনিতে রাশেদ শেখ (৩৭) নামে এক গরু চোর নিহত হয়েছেন। নিহত রাশেদ শেখ মহেশপুর উপজেলার ভালাইপুর গ্রামের মিঠু শেখের ছেলে। একই ঘটনায় গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হয়েছেন নিহত রাশেদের ছোট ভাই রাজদুল শেখ এবং চাচা বজলুর রহমান বটা। বর্তমানে তারা পুলিশ প্রহরায় মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
কালীগঞ্জে জমি বিক্রির কথা বলে টাকা আত্মসাৎ, প্রতিকার চেয়ে ভুক্তভোগীর সংবাদ সম্মেলন
ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার ভোর ৪টার দিকে। স্থানীয় বিশ্বাস পাড়ায় রাজ্জাকের বাড়িতে গরু চুরি করতে গিয়ে গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে রাশেদ শেখ ও তার সঙ্গীরা। এসময় তাদের অপর সঙ্গী শরিফুল ইসলাম পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। চুরির সময় স্থানীয় বাসিন্দা তৌহিদুল খা চোরদের ছুরিকাঘাতে আহত হন। গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে তিনজনকে আটক করে এবং তাদের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে আসে। সেখানে উত্তেজিত জনতা তাদের ওপর গণপিটুনি চালায়, যার ফলে ঘটনাস্থলেই রাশেদ শেখের মৃত্যু হয়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তাদের উদ্ধার করে মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাশেদ শেখ ও তার পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে গরু চুরির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এর আগে নিহত রাশেদের চাচা বজলুর রহমান বটা এবং তার পিতা আনসার শেখ ও ভাই হাকিম শেখকেও গরু চুরির অভিযোগে এলাকাবাসী পিটিয়ে আহত করেছিল। বজলুর রহমান বটা দীর্ঘদিন ধরে মহেশপুরের গরু চোর সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
মহেশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুর রহমান জানান, গরু চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে তিনজন চোর আহত হন এবং রাশেদ শেখ ঘটনাস্থলেই মারা যান। পুলিশ খবর পেয়ে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
মহেশপুর এলাকায় চুরির ঘটনা নতুন নয়। গরু চোরের উপদ্রব এবং এলাকাবাসীর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গণপিটুনির ঘটনা এখানে বারবার ঘটছে। বিশেষ করে গরু চোর সিন্ডিকেটের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় চোরদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। চোরদের এ ধরনের অপরাধে এলাকার মানুষের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। সম্প্রতি গণপিটুনির ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, গ্রামবাসী আইনের প্রতিকার না পেয়ে নিজেরাই আইন হাতে নিচ্ছে।
এ ধরনের গণপিটুনির ঘটনা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু চুরি এবং অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধে যদি যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিজেরাই আইন হাতে নিতে বাধ্য হয়। মহেশপুরের ঘটনাটিও এর একটি উদাহরণ। পুলিশ এবং প্রশাসন যদি গরু চোর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, তাহলে এলাকাবাসীর মধ্যে এ ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
এ ঘটনার পর মহেশপুর এলাকায় জনমনে আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে গরু চুরির শিকার হয়ে আসা এলাকাবাসী তাদের দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে তারা গণপিটুনির মতো সহিংস প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডের নিন্দা করছেন না, কারণ তারা মনে করছেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের বিলম্ব ও উদাসীনতা চোরদের সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে। তবুও অনেকেই মনে করছেন, আইন হাতে না নিয়ে প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখতে হবে।
বাংলাদেশে গণপিটুনির ঘটনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই চলেছে। চুরি, ডাকাতি, কিংবা অন্য কোনো অপরাধের সন্দেহে সাধারণ মানুষ অনেক সময় আইন হাতে তুলে নেয়। এই ধরনের ঘটনা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আইনশৃঙ্খলার গুরুতর অবনতি নির্দেশ করে। দেশে বর্তমানে গণপিটুনির বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে এবং এর মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে। তবুও আইনের কার্যকর প্রয়োগ না থাকার কারণে অনেক এলাকায় মানুষ নিজেরাই আইন হাতে তুলে নেয়।
সরকারি উদ্যোগ এবং নাগরিক সচেতনতা ছাড়া এ ধরনের সহিংস ঘটনা কমানো সম্ভব নয়। গণপিটুনির ফলে একদিকে যেমন অপরাধীদের মৃত্যু হয়, তেমনি এর মাধ্যমে আইন এবং মানবাধিকারের চরম অবমাননা ঘটে। এছাড়া অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিরাও গণপিটুনির শিকার হন, যা সমাজে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে।
মহেশপুরের ঘটনা এবং এর মতো অন্যান্য গণপিটুনির ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় হলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং দ্রুত প্রতিকার দিতে হবে। সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার এবং আইন প্রয়োগের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। একইসঙ্গে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গণপিটুনির মতো সহিংস ঘটনার প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।
প্রায় ৪০ লাখ টাকার গাছ মাত্র ৬ লাখ ২৯ হাজার টাকায় বিক্রি
মহেশপুরে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে হবে। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনকে এলাকায় চুরি এবং অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে আইনের শাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না করা গেলে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে।
ঝিনাইদহে জোরপুর্বক জমি দখল করে গাছ কাটার অভিযোগ, থানায় অভিযোগ
মহেশপুরের এই গণপিটুনির ঘটনা সামাজিক নিরাপত্তা এবং আইনের শাসনের ঘাটতির একটি চিত্র তুলে ধরে। গরু চুরির মতো ঘটনা, যা সাধারণ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, তা সামাজিক উত্তেজনার ফলে এমন সহিংস রূপ ধারণ করে। প্রশাসনের উচিত এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আরও সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।