রবিউল ইসলামের মৃত্যু একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা, যা মায়ের বুক খালি করে দিয়েছে এবং একটি পরিবারকে চরম শোকের মধ্যে ফেলেছে। তাঁর মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত বিয়োগান্ত ঘটনা নয়, বরং এটি সমাজের একটি বৃহত্তর সমস্যা ও সামাজিক অসাম্যর প্রতিফলন। অভাবের সংসারে রবিউল ও তাঁর ভাই জহিরুল ইসলামের জীবনের কাহিনী সাধারণ হলেও এতে রয়েছে সংগ্রামের একটি দৃশ্যমান ধারা, যা দেশের অসংখ্য পরিবারের জন্য পরিচিত।
শেখ হাসিনার বাধ্যতামূলকভাবে গণভবন ছাড়ার ঘটনা, জাদুঘর ও ইতিহাস
রবিউল ইসলাম ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন রিকশাচালক, যিনি ২০১৬ সালে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর রবিউল ও তাঁর বড় ভাই জহিরুল তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। রবিউল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন, কিন্তু পরিবারের আর্থিক অসামর্থ্যের কারণে তাঁকে স্কুল ছেড়ে কাজে যোগ দিতে হয়। তিনি উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের একটি বাসায় কেয়ারটেকার কাম প্রহরী হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর বড় ভাই জহিরুল গাজীপুরে একটি জুতার কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। এই দুই ভাই তাঁদের মাকে এবং ছোট দুই বোনকে নিয়ে সংসার চালাতেন।
রবিউল ইসলাম কখনোই শিক্ষার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেননি। অথচ তিনি ছিল একজন উদ্যমী তরুণ, যিনি জীবনে কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর বড় ভাই জহিরুল এসএসসি পাস করেছিলেন এবং রবিউলও জীবনকে একটু ভালোভাবে চালানোর জন্য গাড়ি চালানো শিখছিলেন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
এই দুই ভাই নিজেদের জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন, পরিবারকে অভাব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই স্বপ্নগুলো কবর হয়ে গেল রবিউলের মৃত্যুর সঙ্গে।
মাকে বলেছিলেন, “আমরা দেশ বদলাতে যাচ্ছি মা, আমি আসব, তুমি চিন্তা করো না।” কিন্তু সেই আসা আর হলো না।
২০২৩ সালের ১৯ জুলাই উত্তরা আজমপুর এলাকায় রবিউল গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর মাথায় দুটি গুলি লাগে, যার মধ্যে একটি গুলি মাথা ভেদ করে এবং আরেকটি মাথায় আটকে ছিল। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে, ২২ জুলাই তিনি মারা যান। রবিউলের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার এবং গ্রামের মানুষজনের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর ভাই জহিরুল বলেন, ‘আমরা জানতাম না সে আন্দোলনে যাচ্ছে। আমাকে নিষেধ করে সে নিজেই আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।’
রবিউলের মৃত্যু তাঁর পরিবারের জন্য এক বিরাট ধাক্কা। মায়ের বুক খালি হয়েছে, ভাইয়ের স্বপ্ন ভেঙে গেছে, এবং একটি পরিবারের আর্থিক ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট হয়ে গেছে। রবিউলের মা জ্যোৎস্না আক্তার বলেন, ‘শেখ হাসিনার লোকজনের গুলিতে আমার ছেলে মারা গেছে। আমি বিচার চাই, আর কিছুই চাই না। এই ছেলেই আমাদের আশা ছিল, কিন্তু সেই আশা এখন আর নেই।’
এই ঘটনাটি শুধু রবিউলের পরিবারের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য একটি বার্তা বহন করে। সমাজে বৈষম্য, বেকারত্ব এবং শিক্ষার অভাবের মতো সমস্যাগুলো তরুণদেরকে এমন পথে ঠেলে দেয়, যেখানে তাঁরা জীবন হারায়। রবিউলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এবং এ ধরনের ঘটনাগুলো সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
জহিরুল ইসলাম বলেন, তাঁদের পরিবারের একমাত্র দাবি, রবিউলকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হোক। তিনি বলেন, ‘আমাদের অভাবের সংসার। বাবা মারা যাওয়ার পর পুরো সংসার আমাদের দুই ভাইয়ের কাঁধে এসে পড়ে। আমরা চাই, আমার ভাই যেন শহীদের মর্যাদা পায়।’
সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের গ্রেপ্তার ও ৭ দিনের রিমান্ড
রবিউলের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার এখন কিভাবে চলবে, তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। তাঁর মা জ্যোৎস্না আক্তার এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন যে, সাত দিন স্যালাইন পুশ করে তাঁকে রাখতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রবিউল আমাদের সংসার ভালো করে চালানোর স্বপ্ন দেখত। গাড়ি চালানো শিখে সে বলত, আমাদের আর কষ্ট থাকবে না। কিন্তু সে নিজেই চলে গেল, আমাদের সেই কষ্ট আর কমল না।’
রবিউলের পরিবার এখন বিচার দাবি করছে এবং তাঁর মৃত্যুকে সমাজে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তাঁর বড় ভাই জহিরুলের কথা অনুযায়ী, তাঁরা অর্থ নয়, বরং রবিউলের মৃত্যুর ন্যায্য স্বীকৃতি চান। তাঁরা চান, রবিউলকে শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক এবং তাঁর নাম আন্দোলনের শহীদদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
শহীদি মার্চ কর্মসূচী ঝিনাইদহে পালিত, ৫ সেপ্টেম্বর
এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে উঠে আসে একটি করুণ বাস্তবতা—যে তরুণেরা নিজেদের জীবন পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, তাঁরা বৈষম্য, অসাম্য, এবং অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংসতার শিকার হয়ে জীবন হারায়। রবিউলের জীবনের গল্প শুধু তাঁর পরিবারের জন্য নয়, বরং এই দেশের অসংখ্য দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা প্রতিদিন জীবনের কঠিন সংগ্রামে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।