সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আফিকুল ইসলাম সাদ। ৪ আগস্ট, ২০২৪, তারিখে একটি ছবি আপলোড করেছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যেখানে ছবির উপরে লেখা ছিল “বাংলাদেশ টু পয়েন্ট ও” এবং ক্যাপশনে যোগ করেছিলেন, “হতে পারে এক নয়া উত্থান” (Could be a new rise)। তিনি কি তখন জানতেন যে, সেই নতুন উত্থানের স্বপ্নের সাথে যুক্ত হবে তার নিজের জীবন? এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে তার পরিবার, বন্ধু, এবং দেশের লাখো মানুষের মনে।
আফিকুল ইসলাম সাদ ছিলেন একজন স্বপ্নবাজ তরুণ। তার নিজের ডিজাইনে তৈরি করা ছবিতে তিনি একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। তার ক্যাপশনে নতুন উত্থানের ইঙ্গিত ছিল, যা তার জীবনদর্শন ও বিশ্বাসের প্রতিফলন। ৪ আগস্টের সেই দিনটিতে সাদ অংশ নিয়েছিলেন একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, যেখানে হাজারো শিক্ষার্থী ও তরুণরা শান্তিপূর্ণভাবে দেশের উন্নতি ও জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নেমেছিলেন।
ওই দিন সারা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল, এবং সাদও সেই আন্দোলনে যোগ দেন। তার পরিবারের মতে, সে দিন সকালে তিনি মা–বাবার কাছে শেষবারের মতো কথা বলে ঘর থেকে বের হন। তিনি তার মাকে বলেছিলেন, “আমরা দেশ বদলাতে যাচ্ছি মা, আমি আসব, তুমি চিন্তা করো না।” কিন্তু সেই আসা আর হলো না।
সেদিনের আন্দোলন একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হিসেবে শুরু হলেও, দ্রুতই তা সহিংসতার রূপ নেয়। সরকারি বাহিনী ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে, এবং সেখানে আফিকুল গুলিবিদ্ধ হন। সহপাঠীরা চেষ্টা করেছিল তাকে উদ্ধার করতে, কিন্তু গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আফিকুলের মৃত্যু তার পরিবার, বন্ধু, এবং সহপাঠীদের জন্য একটি অকল্পনীয় ধাক্কা হিসেবে আসে। তার বাবা-মা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না, যে তাদের স্নেহের সন্তান, যে কয়েক ঘন্টা আগে স্বপ্ন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল, সে আর জীবিত ফিরে আসবে না। “আন্দোলনে তো আরও মানুষ গেছিল, তারা ফিরছে, কিন্তু আমার ছেলে ফিরল না।” আফিকুলের মায়ের এই বেদনার আর্তি যেন সারা দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আঘাত হানে।
আফিকুলের মা-বাবা তাকে হারানোর পর থেকে শোকের মধ্যে আছেন। তাদের মতে, “আমার ছেলে ছিল মেধাবী, সে সবসময় দেশের ভালো চাইত। দেশকে ভালোবাসত, তাই আন্দোলনে গিয়েছিল। কিন্তু কেন আমার ছেলেকেই মরতে হলো?” এই প্রশ্ন তাদের মনে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে, যার কোনো উত্তর তারা পান না।
আফিকুলের বাবা বলছিলেন, “সাদ ছিল আমাদের সংসারের আশা-ভরসা। সে সবসময় পড়াশোনায় ভালো ছিল, ভবিষ্যতে দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ আমার ছেলে নেই। তার স্বপ্নগুলোও শেষ হয়ে গেল। আমরা কিভাবে এই ক্ষতি পূরণ করব?”
আফিকুলের স্কুলের শিক্ষার্থীরা এবং তার সহপাঠীরা তার মৃত্যুতে শোকাহত। তারা বলছে, সাদ শুধু একজন বন্ধু নয়, বরং একজন নেতা ছিল, যে সবসময় অন্যদের উৎসাহিত করত। তার চিন্তাধারা এবং সমাজের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি তাকে বাকিদের থেকে আলাদা করেছিল।
একজন সহপাঠী বলল, “সাদ সবসময়ই সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলত। সে আমাদের দেশের জন্য নতুন কিছু করতে চেয়েছিল। তার মৃত্যু আমাদের কাছে একটা বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে।”
আফিকুলের শিক্ষকরাও তাকে স্মরণ করে বলছেন, তিনি একজন মেধাবী ও দায়িত্বশীল ছাত্র ছিলেন। স্কুলে সবসময় সবার প্রতি সহযোগিতামূলক আচরণ করতেন, এবং তার আচরণে নেতৃত্বগুণের ছাপ ছিল। “সাদ ছিল আমাদের স্কুলের গর্ব। তার মতো একজন মেধাবী ছাত্রকে হারানো আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তার স্বপ্ন ছিল বড়, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করার আগেই তাকে হারিয়ে ফেললাম।”
সেদিনের আন্দোলন ছিল একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ, যেখানে তরুণ প্রজন্ম দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে সরকারের অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল।
আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দাবি জানাচ্ছিল, কিন্তু কিছু জায়গায় সহিংসতার সৃষ্টি হয়। সরকারি বাহিনী এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে সেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সহিংসতার দিকে মোড় নেয়। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন আফিকুল ইসলাম সাদসহ অনেক তরুণ।
আফিকুলের মৃত্যু শুধুমাত্র তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের জন্য নয়, বরং সমগ্র দেশের জন্য একটি শোকের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ডিজাইন করা ছবিটি ছড়িয়ে পড়েছে, এবং তার ক্যাপশনের “হতে পারে এক নয়া উত্থান” বাক্যটি যেন নতুন প্রজন্মের জন্য একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আফিকুলের এই আত্মত্যাগ দেশের চলমান আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার মৃত্যু অনেক তরুণের মনে জাগরণ সৃষ্টি করেছে, যারা এখন আরও দৃঢ়ভাবে আন্দোলনের প্রতি উৎসাহিত হয়েছে।
আফিকুলের মৃত্যুর পর, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার নামে বিভিন্ন প্রচারণা শুরু হয়েছে। তার ডিজাইন করা ছবিটি ভাইরাল হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ এই ছবিটি শেয়ার করছেন।
অনেকে লিখছেন, “আফিকুলের স্বপ্ন ছিল একটি নতুন বাংলাদেশের, যেখানে অন্যায় থাকবে না। সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আমরা সবাই লড়াই করে যাব।”
সামাজিক মাধ্যমে মানুষ তার মায়ের বক্তব্য শেয়ার করছে, যেখানে তিনি বলেন, “আমার ছেলে ফেরেনি, কিন্তু তার স্বপ্ন ফিরবে।”
আফিকুলের মৃত্যুর পর তার পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবরা তাকে একটি জাতীয় শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলেছে। তারা বলছে, “আফিকুল শুধু নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। সে আমাদের সবার জন্য লড়েছিল, এবং তার আত্মত্যাগকে সম্মান জানানো উচিত।”
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং সামাজিক সংগঠনও এই দাবি সমর্থন করছে। তারা বলছে, দেশের জন্য যারা জীবন দেয়, তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিত, এবং আফিকুল সেই সবার মধ্যে একজন।
আফিকুলের মৃত্যু দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। বিরোধীদলগুলো আফিকুলের মৃত্যুকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা বলছে, “সরকারের দমননীতি এবং ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে এই তরুণ প্রাণ ঝরে গেছে। দেশের যুব সমাজের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চলছে।”
অন্যদিকে, সরকারি মহল থেকে বলা হচ্ছে, আন্দোলনের নামে যারা সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আফিকুলের মতো নিরীহ তরুণদের মৃত্যু সরকারের জন্যও একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
আফিকুলের মৃত্যুর পর থেকে দেশের তরুণ প্রজন্ম তাকে একজন অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে দেখছে। তারা বলছে, “আফিকুলের স্বপ্ন ছিল আমাদের সবার স্বপ্ন। সে শুধু নিজের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য লড়েছিল। তার দেখানো পথে আমরা এগিয়ে যাব।”
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আফিকুলের নামে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে। তার মৃত্যু যেন একটি জাগরণের সূচনা করেছে, যা তরুণ প্রজন্মকে আরও সাহসী এবং দৃঢ় হতে শিখিয়েছে।
আফিকুল ইসলাম সাদ ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র, যার স্বপ্ন ছিল একটি নতুন বাংলাদেশের। তার ডিজাইন করা ছবিটি এবং তার ক্যাপশন “হতে পারে এক নয়া উত্থান” এখন একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মৃত্যু দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি নতুন আলোচনার সূচনা করেছে, যেখানে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা ও দায়িত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে।
আফিকুলের মৃত্যু শুধুমাত্র তার পরিবারের জন্য নয়, বরং দেশের জন্য একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। তবে তার এই আত্মত্যাগ যেন দেশের জন্য নতুন প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।