ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকদের বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য
বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের সাবেক কূটনীতিক এবং পর্যবেক্ষকরা। তাঁদের মতে, এই মুহূর্তে ভারতের জন্য সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ হলো “ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ” (অপেক্ষা করা ও দেখা) নীতি গ্রহণ করা, এবং সেইসাথে বাংলাদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বর্তমানে অস্বচ্ছ, জটিল এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল, যা ভবিষ্যতের জন্যও অনিশ্চিত।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের মঙ্গলবারের বিবৃতিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে, পর্যবেক্ষকেরা মন্তব্য করেছেন যে, এই পরিস্থিতিতে ছাত্রসমাজ, জামায়াতের আমির এবং বিএনপির নেতারা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ এবং সহিংসতার নিন্দা করেছেন, যা একটি ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক দেব মুখোপাধ্যায় প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, “বাংলাদেশের পরিস্থিতি এত দ্রুত পরিবর্তিত হবে, তা ভারত পূর্বাভাস দিতে পারেনি। তবে এখন আমাদের একমাত্র বিকল্প হলো অপেক্ষা করা।” তিনি আরও বলেন, “আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন পক্ষের চিহ্নিত প্রক্রিয়া ও লক্ষ্য সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। এ অবস্থায়, আগ বাড়িয়ে কিছু করা ঠিক হবে না।”
অন্যদিকে, সাবেক হাইকমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন, ভারতের পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষমতা রয়েছে। তিনি বলেন, “২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও ভারত কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিল। এমনকি নেপাল ও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি সামলানোও ভারত সফলভাবে করেছে। তাই আমি এই পরিস্থিতিকে বিপর্যয় হিসেবে দেখছি না।”
পিনাকরঞ্জন আরও মন্তব্য করেছেন যে, তিনি সরকারের ভুল সিদ্ধান্তগুলি এবং ছাত্রদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের দিকে একেবারেই অবাক। তাঁর মতে, “রাজাকার মন্তব্য, ছাত্রদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেওয়া এবং ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর সিদ্ধান্তগুলো খুবই প্রশ্নবিদ্ধ।”
মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের (আইডিএসএ) গবেষক স্মৃতি পট্টনায়কও এই পরিস্থিতিতে বিস্মিত। তিনি বলেছেন, “শেখ হাসিনার মতো অভিজ্ঞ নেত্রী যখন পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হন, এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর সমালোচনা এতই বিস্তৃত যে, এটি তাঁর নজর এড়ানো অসম্ভব।”
ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি বাংলাদেশে অরাজকতা নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, “এই অরাজকতাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। ছাত্রসমাজ এবং অন্যান্য অংশগ্রহণকারীরা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কোনো স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।”
ভারতের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বজায় রাখা। অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন, “বাংলাদেশের জনগণ ধর্মীয় মৌলবাদকে সমর্থন করে না। ছাত্রদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সক্রিয়তা আশাব্যঞ্জক।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে, পিনাকরঞ্জন বলেন, “ইউনূসের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কিছু সন্দেহ আছে। তবে, তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে নেতৃত্ব দেওয়া আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের কাছে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
স্মৃতি পট্টনায়ক মনে করেন, “ছাত্রদের চাওয়া, পছন্দ-অপছন্দ সবকিছুই প্রভাবিত করবে। তবে, যে কেউ দায়িত্বে আসুন, ভারতের চাহিদা হলো দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।”
ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকদের মতে, পরিস্থিতি যতই জটিল হোক না কেন, ভারতের লক্ষ্য হওয়া উচিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতে সহযোগিতার পথ খুঁজে বের করা।